অন্তত ৭০ আসনে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ, ৩০টিতে প্রার্থিতা বদলের চিন্তা বিএনপির
![]() |
| বিএনপির লোগো |
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনো চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেনি বিএনপি। তবে মনোনয়নের জন্য ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৭০ আসনে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য নেতাদের সমর্থকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, বিক্ষোভ করছেন, এমনকি সংঘর্ষেও জড়াচ্ছেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছেও অনেকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির মতো বড় একটি দলে মনোনয়ন নিয়ে এমন পরিস্থিতিকে অবশ্য ‘অস্বাভাবিক’ মনে করছেন না দলটির নীতিনির্ধারকেরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁরা কাজ করছেন এবং বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখছেন। এর অংশ হিসেবে অন্তত ৩০ আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল বুধবার বলেন, ‘এ ব্যাপারে কাজ চলছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা সমাধানে তাঁরা কাজ করছেন। আশা করছি, সময়মতো এর ভালো সমাধান হবে।’
গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করে বিএনপি। এর আগে দলের শীর্ষ নেতারা মনোনয়ন নিয়ে বিভক্তি বা অসন্তোষ না হওয়ার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেন। বিভিন্ন বক্তব্যে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে তালিকা প্রকাশের পর মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। নিজ নিজ এলাকায় বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রাণঘাতী সংঘর্ষেও জড়াচ্ছেন দলের নেতা-কর্মীরা।
মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষের চিত্র
২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ বা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকেরা। প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অন্তত ৭০টি আসনে এমন ঘটনা ঘটেছে।
সব বিভাগেই বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৪টি আসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা গেছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগে ১১টি করে ২২টি আসনে, ময়মনসিংহ, রংপুর ও খুলনা বিভাগে ১০টি করে আসনে, বরিশালের ৩টি এবং সিলেট বিভাগের ১টি আসনে অসন্তোষের খবর পাওয়া গেছে।
মনোনয়নবঞ্চিতদের অভিযোগ, ঘোষিত অনেক আসনে নতুন, সুবিধাভোগী, বিগত দিনে নিষ্ক্রিয় থাকা বা প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে ত্যাগী, যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন। তালিকা চূড়ান্ত নয় এবং পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে—দল এমন আশ্বাস দিলেও ক্ষোভ কমছে না বঞ্চিতদের।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এম ইকবাল হোসেইনের পরিবর্তনের দাবিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক তায়েবুর রহমানের কর্মীরা শুরু থেকেই বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা সমাবেশও করেছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে নব্বই বছরের বেশি বয়সী সাবেক এমপি মুশফিকুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও অতীত রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিপরীত পক্ষ। তাঁর প্রার্থিতা বাতিলে প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ হচ্ছে।
একই অবস্থা কুষ্টিয়া-৪ আসনে। আশি বছরের বেশি সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমির মনোনয়ন বাতিলের দাবি করছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদীর সমর্থকেরা। তাঁদের মতে, এতে তরুণ ভোটারসহ বিভিন্ন শ্রেণির সমর্থন ব্যাহত হবে।
ঢাকার বেশ কিছু আসন ঘিরেও প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা-৫ আসনে নবীউল্লাহ নবীকে নিয়ে বিতর্ক আছে, বয়স নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। ঢাকা-১৪ আসনে প্রার্থী হয়েছেন সানজিদা ইসলাম তুলি। তাঁর প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার দাবি তুলছেন এস এ সিদ্দিক সাজুর সমর্থকেরা।
সাজুর প্রার্থিতা দাবিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ১২৬ নেতা তারেক রহমানের কাছে আবেদন দিয়েছেন। তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে জড়িত থাকার ঘটনায় বহিষ্কৃত এনামুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পরে তাঁর বহিষ্কার প্রত্যাহার করা হয়। তৃণমূলের অভিযোগ, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুবিধা নিয়েছেন এবং কর্মীরা নিপীড়িত হলেও তিনি নিরাপদ ছিলেন।
গাইবান্ধা-৪ আসনে এক-এগারোর সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ শামীম কায়সার লিঙ্কনকে প্রার্থী করায় তৃণমূলের একটি অংশ ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, জনপ্রিয় নেতা ফারুক আহমেদকে মনোনয়ন না দিলে আসনটি ঝুঁকিতে পড়বে।
নেত্রকোনা-৫ আসনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাধিক অশালীন ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। নরসিংদী-৪ আসনে সংস্কারপন্থী ও অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ থাকা সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে।
নাটোর-১ আসনে মনোনীত ফারজানা শারমিন পুতুলের প্রার্থিতা বাতিলের দাবিতে তাঁর ভাই ইয়াসির আরশাদ রাজন আন্দোলন করছেন।
পরিস্থিতি সামলাতে তৎপর দল
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষের বিষয়টি আলোচনায় আসে। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তারেক রহমান। বৈঠকে বিতর্কিত ও সমালোচিত প্রার্থীদের পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্র জানায়, সিলেট-৬, নেত্রকোনা-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, জামালপুর-২, কুষ্টিয়া-৪, সিরাজগঞ্জ-৩, চট্টগ্রাম-১২ ও ১৩সহ অন্তত ৩০ আসনে পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
দলের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন নিয়ে গঠিত একটি দল অভিযোগ যাচাই করছে। তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে তালিকা সংশোধন করা হবে।
সূত্র বলছে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিরোধপূর্ণ আসনের সব পক্ষকে ডেকে কথা বলছেন। গুলশান কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক হচ্ছে। মনোনয়ন নিয়ে বড় ধরনের ক্ষোভ নিয়েই নির্বাচন চাইছে না বিএনপি। তাই তারেক রহমানও নিজে মনোনয়ন না পাওয়া ক্ষুব্ধ অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলছেন।

Comments
Comments