[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে জয়ী করতেই হবে

প্রকাশঃ
অ+ অ-
যুদ্ধ শেষে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাস, ডিসেম্বর ১৯৭১, দোহার, ঢাকা | ছবি: আনোয়ার হোসেন

স্বাধীনতাযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে। যুদ্ধের স্মৃতি তরতাজা। কিন্তু অনিশ্চয়তায় ছিল যোদ্ধাদল। পরবর্তী করণীয় নিয়ে গঠনমূলক দিকনির্দেশনা ছিল না বিজয়ীদের জন্য। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলেন তাঁরা যে যাঁর মতো।

এ সময় গ্রেনেড নামের একটা ছোটকাগজে ১১ নম্বর সেক্টরের প্রধান আবু তাহেরের একটা লেখা প্রকাশিত হলো ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার বিজয়ী হবে’ শিরোনামে। শিরোনামটা চমকে ওঠার মতো। একজন সেক্টর কমান্ডারকে এভাবে বলতে দেখে প্রশ্ন উঠল, একাত্তরের যোদ্ধারা কি হেরে গেছেন তাহলে?’

সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে আবু তাহের তখন বেসামরিক মানুষ। অতৃপ্তি নিয়ে ওই লেখায় তিনি বলছিলেন, একাত্তরের যোদ্ধারা বিজয়ী হলেও কার্যত হেরে যাচ্ছেন নেতৃত্বের কারণে। তাঁরা যুদ্ধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেও সেই সরকারি কর্মকর্তাদের সরাতে পারেননি, যারা স্থানীয় জনসমাজের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিরোধী ছিল। সে সময়ের অবস্থা নিয়ে কবি লিখেছেন, ‘ওসমানির কাগজ পেয়েছিল যে, সে মুক্তিযোদ্ধা—যে সই দিয়েছিল নিজের কাগজে, সে–ও মুক্তিযোদ্ধা।’

হতাশার আরও বড় জায়গাও ছিল। একাত্তর, নব্বই এবং চব্বিশেও বাস্তব অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা বদলানোর এমন কোনো কর্মসূচি পাওয়া যায়নি, যা জনতার বড় অংশের মেরুদণ্ড প্রতিদিন বাঁকা করে দেয় খানিকটা। ফলে জয়ী হয়েও যোদ্ধাদল হেরেছে। বাংলাদেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক যুদ্ধের ইতিহাস অনেকটাই এ রকম।

১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যে প্রশাসন অবৈধ সামরিক শাসকের সহযোগী ছিল, ১৯৯০ সালের পরে কোনো সরকার কি তাদের জবাবদিহির আওতায় এনেছিল? গত ১৫ বছরের কুখ্যাত সব নির্বাচন কি সে সময়ের বড় বড় কর্মকর্তার সহযোগিতায় হয়নি? গণ–অভ্যুত্থানোত্তর ২০২৬ সালের নির্বাচন ওই কর্মকর্তাদের কতটা অংশগ্রহণমুক্ত থাকবে, আমরা জানি না।

যোদ্ধা আর বিরোধিতাকারীরা বারবার এভাবে একাকার হয়ে যায় এখানে। এটি কেবল যুদ্ধের ব্যর্থতা নয়, বিজয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও। বিশ্বাসঘাতক সময়ে অতীতের সব বড় সংগ্রাম শেষেই ক্ষমতা ধীরেসুস্থে পুরোনো আমলাতন্ত্র ও বাজারব্যবস্থার বড় প্রকৌশলীদের হাতে ফিরে গেছে। জনতা তাদের জবাবদিহিতে আনতে পারেনি। একাত্তর-নব্বই-চব্বিশের এ রকম পুনঃপুন অপরিবর্তনশীল অবস্থার জন্য সব সময় দোষের ভাগীদার হচ্ছে আবার যোদ্ধাদলই।

এ রকম ‘দোষ-খোঁজা দল’ই চব্বিশের লাল জুলাই শেষে সংস্কারের চাপ ও অভিমুখ বদলাতে একাত্তরের যোদ্ধাদলকে হেনস্তা করতে নামে। চব্বিশকে তারা একাত্তরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়; যেন চব্বিশের অভ্যুত্থান হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকেই এখন শুনতে হচ্ছে বেগম রোকেয়া মুরতাদ-কাফির ছিলেন। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশীদার। ৫৪-৫৫ বছরে অনেক কিছু বদলে গেল এবং বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছেও।

একাত্তরের পর এবং বিশেষভাবে ২০২৪–এর আগের ১৫ বছর মুক্তিযুদ্ধকে যে ভয়ানক রকমে দলীয়করণ, পরিবারকরণ ও ব্যবসায়ের পণ্যে পরিণত করা হয়েছে, সেটা ছিল এক বিকৃত বাস্তবতা। তার সঙ্গে ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ঘটনাবলি, আত্মত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা ও অর্জনের কোনোই সম্পর্ক ছিল না। বিগত শাসনামলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতে গিয়ে গত ১৬ মাসে দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য জাদুঘর, স্থাপনা, স্মারকচিহ্ন লুণ্ঠন ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে গত বছরের লাল জুলাইয়ের সম্পর্ক কোথায়? এই সবই ছিল একাত্তরকে খাটো করার, প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং ওই জাতীয় গৌরবকে ম্লান করার পরিকল্পিত চেষ্টা। এই চেষ্টাকারীরা সফলভাবে চব্বিশের শিক্ষার্থীশক্তির ভেতর ঢুকে পড়েছিল। এটা ছিল একটা রাজনৈতিক-আদর্শিক অ্যাম্বুশ। বিগত সরকারের মুক্তিযুদ্ধ-ব্যবসায় বিরক্ত মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে এ কাজগুলো হয়েছে এবং এখনো থেমে থেমে সেসব কাজ চলছে। এই অ্যাম্বুশে অনেক খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীও নিয়মিত জ্বালানি জুগিয়েছেন।

অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা তার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনার পদত্যাগ আন্দোলনে একাত্তরবিরোধী বক্তব্য বা কর্মসূচি ছিল না। বরং একাত্তরের সাহসী চৈতন্য এবং একই রকম ঐক্যের বোধ থেকে সেই আন্দোলনে সবাই একত্র হয়েছিল। সেই আন্দোলন কার্যত একাত্তরের মর্মকে মুক্তিযুদ্ধ-ব্যবসায়ীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল। একাত্তরে দেশের দুই দিকের অর্থনৈতিক বঞ্চনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে পাকিস্তানের শাসকদের দিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশ্ন ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ আর লাল জুলাইয়ের মূল ব্যানারেই ছিল ‘বৈষম্য’ কমানোর কথা। কিন্তু তার কী হলো বা হচ্ছে? দেশ-বিদেশের প্রায় সব অর্থনৈতিক গবেষক বলছেন, চার বছর ধরে বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো দারিদ্র্য কমার বদলে বাড়ছে। আবার অপর দিকে ঘটছে একদম উল্টো ঘটনা। ২০২০ সালে দেশের ব্যাংকগুলোতে এক কোটির বেশি অর্থ আছে এমন অ্যাকাউন্ট ছিল ৯৩ হাজারের মতো (আজকের পত্রিকা, ২১ মার্চ ২০২৩)। এ বছরের সেপ্টেম্বরে সেটা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার (যুগান্তর, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫)।

দেশে মানুষের হাতে সম্পদ বাড়লে সেটা সুখকর খবর। কিন্তু যখন দারিদ্র্য কমার বদলে ক্রমে বাড়ে, সে সময় ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর হাতে তীব্র গতিতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের মূল সংকটটা এখানেই। সম্পদ বাড়ছে, কিন্তু তার সুষম বণ্টন নেই। প্রধানত এ কারণেই একাত্তর-নব্বই-চব্বিশ ঘটেছে এবং আবারও সে রকম কিছু ঘটার বিপদ জারি আছে। ২৮ শতাংশ দারিদ্র্য নিয়ে কোনো দেশ অন্ততকাল গণ–অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।

অথচ চব্বিশের সুফল ভোগ করতে যাওয়া বড় দলগুলোর খ্যাতনামা নেতাদের সভা-সমাবেশের বক্তব্য থেকে মনে হচ্ছে, দেড় দশকের মুক্তিযুদ্ধ–ব্যবসার বিপরীতে নতুন রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহারের দিকে তাঁদের আগ্রহ। এখন পর্যন্ত এ রকম দলগুলোর কোনো নেতা বলেননি যে সংসদে গিয়ে তাঁরা করনীতির সংস্কার করে উচ্চ আয়ের মানুষদের থেকে বাড়তি সম্পদ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের স্বাস্থ্য-শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াবেন। বরং তাঁরা ধর্ম, শরিয়াহ ইত্যাদির দিকে হাত বাড়াচ্ছেন; কাকে মুসলমান বলবেন, কাকে অমুসলমান ঘোষণা করবেন—সেসব নিয়ে কথা বলছেন।

অথচ ‘৩৬ জুলাই’ ধ্বনিত হয়েছিল কেবল নাগরিক পরিচয়ের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা। এরপরও একাত্তর বনাম চব্বিশের মেরুকরণ এবং পরস্পরবিরোধী নানা সামাজিক পরিচয়বাদ অনেকের খুব দরকার। ওয়াজ ও সংস্কৃতি, নারী ও পুরুষ, হিন্দু ও মুসলমান, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, বাঙালি ও আদিবাসী, ভারত ও পাকিস্তানসহ নানা ধরনের মেরুকরণ অনেকের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে খুব দরকার। দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ব্যবধান নিয়ে, প্রশাসক ও জনগণের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা নেই। এদেরই আগের দল ১৯৭২–এ পুরোনো রাষ্ট্রকাঠামো ও উৎপাদন সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে বিজয়ী যোদ্ধাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। একই শক্তির নতুন সংস্করণ ২০২৪–এ সভা-সেমিনার-ইউটিউবের মাধ্যমে এমনভাবে এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বাধাল যে জুলাই যোদ্ধারা নির্বাচনী মাঠের মূল প্রতিযোগিতা থেকে ইতিমধ্যেই অনেকটা ছিটকে পড়লেন।

এটা এখনই অনুমান করা যায়, গণতন্ত্রের সৌধ গড়তে শত শত সহযোদ্ধাকে হারিয়ে যে তরুণ দল নির্বাচন ছিনিয়ে আনল, তারা আসন্ন নির্বাচন শেষে সরকার গঠনের সম্ভাবনায় অনুপস্থিত থাকছে। বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা আবারও এক অর্থে পরাজিতই হলো। কিন্তু এ রকম প্রতিটি পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার ঋজু, সংহত ও প্রস্তুত না হয়ে উপায় নেই। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।

মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে। তাঁদের জয়ী হতে হবে একাত্তর, নব্বই বা চব্বিশের অবদান নিয়ে ব্যবসার জন্য নয়, সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের ঠোঁট সেলাই করে রাখার জন্য নয়, ভারত বা পাকিস্তান বা আর কারও কাছে মাথা নত করে রাখার জন্য নয়, বরং আসন্ন নতুন বিশ্বে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে গড়ার জন্য। এটাই মৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছে জীবিত সহযোদ্ধার অঙ্গীকার ছিল। এ কারণেই অন্ধকার রাস্তায় ১৬ ডিসেম্বর উজ্জ্বল মাইলফলকের মতো স্পষ্ট পথ দেখায়। ওই দিনটির মধ্যে বঙ্গের শত শত বছরের এক জনজাতিগত আবেগ ও শক্তি ঘনীভূত হয়ে আছে। কেবল সে জন্যই এক কোটি শরণার্থীকে পশ্চিমবঙ্গ ও আশপাশের মানুষ হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। তারা নয়াদিল্লির ভূরাজনীতি নিয়ে ভাবিত ছিল না। তারা জানত, এ হলো বহুকাল পিঠে রক্তজবা–ক্ষত নিয়ে পথচলা এক জনসমাজের নতুন দিগন্ত তৈরির চেষ্টা। তারা দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যা করছিল কেবল। সে চেষ্টারই প্রতীক একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর, নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর এবং চব্বিশের ৩৬ জুলাই। এসব শ্রাবণের মেঘদলের মতো যূথবদ্ধ স্মৃতি বাংলাদেশের।

একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে বারবার পরাস্ত যোদ্ধাদল অব্যাহত এক মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়। কারণ, তারা জানে ১৯৪৭ ও ১৯৭১–এ রাষ্ট্র পেলেও সেটা আসলে ১৭৯২–এর কর্নওয়ালিসের কলকবজায় মোড়ানো। তার পরতে পরতে প্রভুতন্ত্র আর কর্তৃত্বের বাসনা। মুক্তির পথের এ রকম প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণের বিকল্প নেই। বলা যায়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সব ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নতুনভাবে মোটাদাগে অন্তত ছয়টি কর্তব্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজ।

এক. উপনিবেশী রাষ্ট্রকাঠামো বদলের লক্ষ্যে বিস্তারিত ব্যবহারিক কর্মসূচি তুলে ধরা;

দুই. তীব্র ধনবৈষম্য ও আয়বৈষম্য কমানোর বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি তৈরি এবং টেকসই স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়া;

তিন. অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বহুজনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রসার;

চার. ইসলাম বনাম বাঙালিত্ব মেরুকরণ উসকে জুলুম ও সামাজিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা প্রতিরোধ;

পাঁচ. প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা এবং বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার রুটি-রুজির সংগ্রামে শক্তি জোগানো এবং

ছয়. নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে আগামী দিনে প্রকৃতই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি।

এসবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ ও নানামুখী চাপ এবং ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার, পুশইন এবং সীমান্তজুড়ে নতুন সামরিক স্থাপনা দুই বড় বিপদ আকারে হাজির হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব ভূরাজনৈতিক বিষয়েও আমাদের একটা বাস্তবসম্মত, সুচিন্তিত, সাহসী অবস্থানে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

এসব লক্ষ্যে এগোতে নতুন করে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর জাতীয়ভিত্তিক ঐক্য দরকার। ঐক্য বা মোর্চা হতে হবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই ও চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের মূল্যবোধকে ধারণ করে এবং ওপরের তিন ঐতিহাসিক অধ্যায়ে যুক্ত শক্তিগুলোকে পুনর্গঠিত করে।

একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের মৌলিক ঐকমত্যের জায়গা হিসেবে ওপরের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে আরও অনেক লক্ষ্য যুক্ত করা যায়। গত ৫৫ বছরে তিনটি বড় রাজনৈতিক প্রচেষ্টার পরও কোনো প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা এই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারেনি। কিন্তু সেসব লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ যে বিচ্যুত হতে পারছে না, তা–ও মৌলিক বাস্তবতা।

এসব লক্ষ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক পরিসরের পুনর্বিন্যাস দরকার। এ কাজ পুরোনো নেতৃত্ব বা সমকালীন নাগরিক সমাজ পারবে বলে মনে হয় না। ২০২৪ সালে সুযোগ পেয়েও তাঁরা পারেননি। সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র উভয় ধরনের গণ–অভ্যুত্থানের একাধিক অভিজ্ঞতার পরও তাঁরা অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের গঠনমূলক কাজে সংঘবদ্ধ করতে পারেননি, দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি।

ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি দেশ এ রকম লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিল। কারণ, তাদের ‘মুক্তি’র যুদ্ধটা ছিল পরিকল্পিত এবং বিজয়ী যোদ্ধাদলই রাজনীতির নেতৃত্ব নিয়েছিল। ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪–এ বাংলার মানুষ লড়ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তারা অকুতোভয় ছিল। তাদের সৎ ও ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সেই সৎ ও ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে অনুবাদের জন্য আমলাতন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থবাদী গ্রাম-শহরের গোষ্ঠীগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে পারেননি যোদ্ধারা। পুরোনো রাজনীতি একাত্তর, নব্বই, চব্বিশ—তিন যুদ্ধেই যোদ্ধাদলকে ভাড়াটে সৈনিকের মতো যুদ্ধ শেষে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। দেশ গঠনে অংশ নিতে দেয়নি। আগামীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাই রাজনৈতিক পুনর্ভাবনা জরুরি এবং এখনই তার সময়। কেবল এ পথেই আজ ও আগামীকালের মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হতে সক্ষম এবং সেটা জরুরি।

 ● লেখক: গবেষক 

Fetching live reactions...
Was this article helpful?

Comments

Comments

Loading comments…
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন