[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

আলোচনা সভায় অভিযোগ উঠল, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে হয়েছে প্রতারণা

প্রকাশঃ
অ+ অ-
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত সভায় আলোচকেরা | ছবি: আদিবাসী যুব ফোরামের সৌজন্যে

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তিচুক্তি) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এ চুক্তি পাহাড়ি মানুষের স্বপ্ন ও আশা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়নি। এতে তিন পার্বত্য জেলায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, শান্তি ও শৃঙ্খলার সমস্যা বেড়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের ২৮ বছর পরও তা বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর দায়হীনতা স্পষ্ট।

‘জাতীয় ঐক্য সুসংহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এই আলাপচারিতার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী অধিকারকর্মী অমর শান্তি চাকমা। প্রবন্ধে বলা হয়, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৮টি ধারা আংশিক এবং ২৯টি ধারা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের সময়ও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

প্রবন্ধে আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়—পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী করা, জেলা পরিষদের অধীন অহস্তান্তরিত বিভাগগুলো হস্তান্তর, ভূমি কমিশনকে ক্ষমতায়ন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করে তিন জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন আয়োজন। এ ছাড়া স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে মিশ্র পুলিশ বাহিনী গঠন, পাহাড়ের অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প সরানো, চাকরিতে স্থানীয় পাহাড়িদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা এবং পাহাড়িদের কৃষ্টি–সংস্কৃতি রক্ষায় আইনি ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

মানবাধিকারকর্মী ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশি কবীর বলেন, ‘চুক্তি সই করার পরই বোঝা গেছে প্রতারণা করা হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলব, চুক্তির মূল অংশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি ছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন হতে দেওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কমিশন গঠন করলেও যেন তা কাজ করতে না পারে, সেজন্য নানা বাধা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় মদদে বিভিন্ন বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯০০ সালের বিধি এবং পাহাড়িদের ভূমি–সংস্কৃতিভিত্তিক স্বীকৃতি স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে উপেক্ষিত হয় বলে মন্তব্য করেন খুশি কবীর। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও রাষ্ট্র তা বাস্তবায়ন না করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্থায়ী ঝুঁকি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চক্রে ফেলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য কে এস মং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা শুরু থেকেই জাতীয় সমস্যা। রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন আন্দোলন করেছে। ডাকসুর উদ্যোগে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্রসমাজের ৯ দফাতেও স্পষ্ট বলা ছিল—পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। সরকারের সঙ্গে জেএসএসের বৈধ আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। নানা পর্যায়ের আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কোনো রাজনৈতিক দল শেষ পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেনি। চুক্তির সময় ১৪৭ দেশের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রমাণও দেয়।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ব্যক্তিগত নয়। এটি রাষ্ট্র ও একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন–জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গীকার। তাই এ চুক্তিকে পাশ কাটানো সম্ভব নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভ দেখিয়ে চুক্তিকে ঝুলিয়ে রাখলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি সাজ্জাদ জহির বলেন, পার্বত্য চুক্তি রাষ্ট্রের দেওয়া অঙ্গীকার। কিন্তু রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র ও শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের কারণে ২৮ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমি অধিকারই সবচেয়ে বড় সংকট, যা পাহাড় ও সমতলের সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, পার্বত্য চুক্তি দেশের শান্তি–সমৃদ্ধির জন্য জরুরি হলেও ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আদিবাসী পরিচয় ও ভূমি অধিকারের বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরি করা হচ্ছে, যা নতুন প্রজন্মকেও প্রভাবিত করছে। তিনি চুক্তির পক্ষে দেশজুড়ে প্রচার–সমাবেশে তথ্যকেন্দ্র চালু করা এবং মানুষের সঙ্গে প্রশ্ন–উত্তরের সুযোগ তৈরির আহ্বান জানান।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদ সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পার্বত্য চুক্তি দীর্ঘদিনের প্রতারণার উদাহরণ, যা পাহাড়ি জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে যায় না। ১৯৯৭ সালের চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি, হয়েছে শুধু শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছামতো। রাষ্ট্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতারণা করলে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, পার্বত্য চুক্তি রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে চুক্তি, কোনো বিশেষ সরকারের নয়। এটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, শান্তি ও শৃঙ্খলার সমস্যা বেড়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে পার্বত্য চুক্তিসহ সব আদিবাসী দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক হিরণ মিত্র চাকমা। আলোচনায় বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন