বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতা দমিয়ে রাখাই বর্তমানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার
![]() |
| শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা। ১৪ ডিসেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদের বর্বর ও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, যার ফলে দেশকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস আরও ভালোভাবে জানা উচিত। বর্তমান সময়ে বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে রাখাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এখন সব বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার প্রতিফলন চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে দেখা গেছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমিতে দুই দিনব্যাপী সেমিনারের প্রথম দিনে রোববার এসব কথা বলেন বক্তারা। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘বুদ্ধিজীবীর জবান ও জীবন: ইতিহাসের আলোকে, আখেরি ফ্যাসিবাদের জমানায়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও গবেষক তাহমিদাল জামি।
প্রবন্ধে বলা হয়, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে যে প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল, সেটিকে একপ্রকার ফ্যাসিবাদ হিসেবে শনাক্ত করা যায়। সেই ফ্যাসিবাদের পেছনে ছিল প্রজা বা বান্দাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছাঁচে ঢেলে গড়ে তোলার প্রকল্প। মুক্তিযুদ্ধকালে যে ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে এবং বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা মূলত সামাজিক পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সহিংস হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা।’
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ‘আমাদের যুগে ফ্যাসিবাদ কাকে বলে তা নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা যায়। কিছু মানুষ পাকিস্তানি শাসনকে ফ্যাসিবাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন, কিন্তু এর অর্থ বা গভীর আলোচনা তেমন দেখা যায়নি। ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদ নিয়েও সম্প্রতি নানা বিতর্ক হয়েছে। এসব আলোচনায় তাত্ত্বিক গভীরতা মেলেনি। পাক শাহি ও তাদের সহযোগী আলবদর গোষ্ঠীগুলো ফ্যাসিস্ট, এ কথাটি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বুদ্ধিজীবী আলমগীর কবির তাঁর বেতার কথিকায় উল্লেখ করেছিলেন।’
প্রবন্ধের শেষ অংশে বলা হয়, ‘আজও বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে নিপীড়িত ও নিশানায়িত। আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক কবি ও লেখককে নিধনযোগ্য হয়ে যেতে দেখেছি। বুদ্ধিজীবীর তৎপরতাকে দমিয়ে রাখা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার। মৃত বুদ্ধিজীবীরাও সবসময় নিরাপদ নয়। সম্প্রতি এক পীরের সমাধি খুঁড়ে লাশ দাহ করা হয়েছে। লিবারাল নিয়ম ও ফ্যাসিবাদের উপস্থিতি একসাথে থাকলে, জবানের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনের নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়।’
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং এর পরেও অনেক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন। সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছেন জহির রায়হান। যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু এই বিষয় যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন নানা প্রশ্ন ও দ্বিধা দেখা দেয়। যেমন, কে মেরেছে বা কারা মেরেছে—এসব প্রশ্ন উঠানো জরুরি। তবে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, তাঁদের জীবন দেওয়া হয়েছে, এবং তা নষ্ট করা হয়েছে।’
স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সচিব মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘বাংলা একাডেমির সঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবীর গভীর সম্পর্ক ছিল। এখানে তাঁদের পদচারণা ছিল। বাংলা একাডেমি তাঁদের জীবন নিয়ে বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ ও সারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। ১৪ খণ্ডে ‘স্মৃতি একাত্তর’ সিরিজ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের জীবনী নিয়ে রচনাবলি প্রকাশ করা হয়েছে, এবং অনেক ব্যবহার্য জিনিসপত্রের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেন, ‘আমরা কখনো ভাবিনি যে বন্দুকের সামনে বুক দিতে হবে। তবে কেউ যখন বুক দিয়েছে, তার পর আর কোনো অভাব থাকে না। ১৫–২০ বছর ধরে যা অচল ছিল, তা ৩৫–৩৬ দিনে সবকিছু উল্টেপাল্টে দেওয়া গেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাভিন মুরশিদ বলেন, ‘আজকের বুদ্ধিজীবী দিবসে আমি ভাবছি, এত বড় ক্ষতি হয়েছে, তবুও আমরা এখনও বের হতে পারিনি। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা জানতেন, যুদ্ধ শেষ, আর জেতার সুযোগ নেই। যাওয়ার আগে তারা দেশকে পঙ্গু করতে চেয়েছিল, এবং সেটা সফল হয়েছে। তারা আমাদের পঙ্গু করেই গেছে।’
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন শিল্পী ও লেখক অরূপ রাহী। তিনি বলেন, ‘সমাজের একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা—এই সবকিছুকে অস্বীকার করার মনোভাব ও তৎপরতায় বাস করে।’
দ্বিতীয় দিন ১৫ ডিসেম্বর সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার গতিপথ ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন লেখক ও গবেষক সহুল আহমদ।

Comments
Comments