অবৈধ অস্ত্র বেড়ে জনজীবনে নিরাপত্তা সংকট

অবৈধ অস্ত্র | প্রতীকী ছবি

রাজধানীসহ সারা দেশে ক্রমেই বেড়েই চলেছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র মজুত করছে এবং এসব ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুন ও সহিংসতা চালাচ্ছে। বুধবার পাবনার ঈশ্বরদীতে গুলিতে বিএনপির এক নেতা নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় গুলি করা হয়। চট্টগ্রামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে সন্ত্রাসীরা একাধিক রাউন্ড গুলি চালিয়েছে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ধারাবাহিক খুন ও সশস্ত্র হামলার ঘটনায় জনমনে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকির কারণে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিএনপি মনোনীত এক প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থানাগুলো থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া এবং সীমান্তে ফাঁকফোকর দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্র আসার কারণে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এই পরিস্থিতি আরও বেড়ে যেতে পারে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশব্যাপী অভিযান চালাচ্ছে, অস্ত্র উদ্ধার সীমিত পরিসরে হয়েছে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মুখপাত্র উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী জানান, সারা দেশে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে র‌্যাবের সব ইউনিট কাজ করছে এবং নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগ বা আতঙ্কের কোনও কারণ নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা আব্দুস শহিদ বলেন, 'সারা দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র থাকার প্রমাণ আছে। আসন্ন নির্বাচনের সময়ে তারা এসব ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মিলিয়ে ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযান চালাচ্ছে, যা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। এই অভিযানে অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে। এটিকে আরও জোরদার করতে হবে, বিশেষ করে টার্গেট এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। মানুষের মনে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা কমে যাবে। তবে বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে এবং এবারও তা করবে।'

উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদিকে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। এর একদিন আগে, ১১ ডিসেম্বর পুরোনো ঢাকার শ্যামবাজারে মসলা ব্যবসায়ী আবদুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েক দিন আগে খুলনায় আদালতপাড়ায় প্রকাশ্যে দুজনকে হত্যা করা হয়। এর আগে মিরপুর এলাকায় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। বুধবার পাবনায় প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপি নেতা বিরু মোল্লা (৬৫) গুলিতে নিহত হন। নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মো. মাসুদুজ্জামান মাসুদ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে সারা দেশে ২৭৯টি হত্যা মামলা হয়েছে। এছাড়া ডাকাতি ও দস্যুতার ১৮৪টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১,৭৪৪টি, অপহরণের ৯৩টি, চুরি-ছিনতাইয়ের ১,১১০টি মামলা হয়েছে। সারা দেশে অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগে মোট ১৪,৪৬৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপির অধীনে থানাগুলোতে সর্বোচ্চ ১,৩৮৩টি মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে ৪১২টি এবং গাজীপুর মহানগরে ২৭০টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। অন্যান্য মহানগরী ও থানা, যেমন রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও বরিশালে তুলনামূলক কম মামলা হয়েছে।

গত ১৫ মাসে দেশব্যাপী কমপক্ষে ৪,৮০৯টি খুনের মামলা হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসে ৩,২৩৬টি খুনের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ৫৫১টি খুনের মামলা নথিভুক্ত করেছে। অনেক মামলা ৫ আগস্ট বা তার আগে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও সম্প্রতি নথিভুক্ত হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ৫ আগস্টের পর লুট হওয়া ও জমা না দেওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলমান। ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট: ফেজ-২’-তে সারা দেশে অভিযান চালানো হচ্ছে। মঙ্গলবার সারা দিনে ১,৯২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫২৩ জন বিভিন্ন মামলা ও ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অপারেশনে আরও ১,৩৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার আগে নানা উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। পুলিশকে সতর্ক অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ডিএমপির মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, 'প্রতিটি থানার এলাকায় বিশেষ অভিযান চলছে। গোয়েন্দা পুলিশ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছে। চেকপোস্টে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। উদ্বেগ বা আতঙ্কের কোনও কারণ নেই।' 

অপরদিকে, মাসুদুজ্জামান মাসুদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, 'সার্বিকভাবে দেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কোনও শঙ্কা নেই। কোনও প্রার্থী যদি নিরাপত্তার কারণে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন, তা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।'