নাগরিকের মুঠোফোন ঘাঁটছে পুলিশ, আইন কী বলে?
![]() |
| ঢাকার সাভারের আমিনবাজারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে বাসের এক যাত্রীর মুঠোফোনে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। ১২ নভেম্বর বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কারও মুঠোফোনে আসলে কী কী থাকে—এই প্রশ্নের চেয়ে বরং কী থাকে না, তা খুঁজে বের করা সহজ। কারণ এখন মুঠোফোনে একজন ব্যক্তির প্রায় সব ব্যক্তিগত তথ্য থাকে—সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিওসহ অফিসিয়াল নথি সবই সংরক্ষিত থাকে। তাই মুঠোফোন শুধু একটি ডিভাইস নয়, এটি ব্যক্তির নিজস্ব সত্তার এক বিস্তার।
তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কি তল্লাশির নামে যেকোনো সময় নাগরিকের মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারে, তাঁদের ব্যক্তিগত দুনিয়ায় প্রবেশ করতে পারে? যদিও দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দিনের পর দিন এটাই করছে।
সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ধরতে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও মেসে অভিযান চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় বহু মানুষের মুঠোফোনও তল্লাশি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পুলিশের এ ধরনের আচরণ নতুন নয়। বিগত সরকারের আমলেও বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘিরে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নাগরিকের মুঠোফোন পরীক্ষা করা হতো। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও এ ধরনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—আইন কি এই ধরনের তল্লাশির অনুমোদন দেয়?
বিএনপি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সমাবেশ ডেকেছিল। সে সময় ১০ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘তল্লাশির সময় পুলিশকে মোবাইল দেখাইতে হইছে, এটা কেমন আচরণ?’
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর উত্তরার কামারপাড়া মোড়ে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে বাস, মোটরসাইকেলসহ যানবাহনগুলো তল্লাশি করা হয়। পাশাপাশি মুঠোফোনও পরীক্ষা করা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে বিএনপির ডাকা সমাবেশকেও কেন্দ্র করে পুলিশ মোড়ে মোড়ে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নাগরিকদের মুঠোফোন পরীক্ষা করেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশ শুধু একা এই কাজ করেনি। দলটির ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যরাও মানুষের মুঠোফোন পরীক্ষা করেছিল। ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই প্রকাশিত খবরে বলা হয়, শাহবাগে লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের খুঁজতে গিয়ে মানুষের মুঠোফোনও পরীক্ষা করেছিল।
জুলাইয়ের ওই গণ-অভ্যুত্থানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেসে মেসে গিয়ে তাদের মুঠোফোনও পরীক্ষা করা হয়েছিল।
পুলিশের এই আচরণ নতুন নয়। বিগত সরকারের আমলেও বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘিরে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নাগরিকের মুঠোফোন ঘাঁটাঘাঁটি করা হতো, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—আইন কি এই তল্লাশির অনুমোদন দেয়?
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতন ঘটে, এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বন্ধসহ এর অঙ্গসংগঠনগুলোও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দলটির শীর্ষ নেতারা দেশ–বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় শেখ হাসিনার বিচারের রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন ছিল ১৩ নভেম্বর। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ অনলাইনের মাধ্যমে ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ডাকে।
এই কর্মসূচির সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুন দেওয়া, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সরকার বলছে, এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ দায়ী। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযানের সময় মুঠোফোন চেক করার অভিযোগও উঠেছে।
মুঠোফোন মানুষের আয়রোজগার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয়। কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়া, আদালতের অনুমতি ছাড়া এভাবে গণহারে মুঠোফোন চেক করা মানুষের গোপনীয়তার অধিকার, চলাচলের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।
১২ নভেম্বর একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়—‘সন্দেহ হলে আমিনবাজারে তল্লাশি করা হচ্ছে যাত্রীদের ব্যাগ ও মুঠোফোন’। প্রতিবেদনে বলা হয়, সকাল থেকে ঢাকার প্রবেশপথ আমিনবাজারে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালায় ঢাকা জেলা পুলিশ। তল্লাশির সময় সন্দেহজনক মনে হলে যাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্ন করার পাশাপাশি তাঁদের ব্যাগ ও মুঠোফোনও পরীক্ষা করতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের।
একই দিনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুঁজতে মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ফকিরেরপুল, কাকরাইল, এলিফ্যান্ট রোডসহ নগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় যাচাই করা হয়, ওই ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, এবং নাগরিকদের মুঠোফোনও পরীক্ষা করা হয়।
শুধু পুলিশ নয়, বর্তমান সরকারের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুঠোফোন পরীক্ষা করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) শিক্ষার্থী আবির হাসান। এই ঘটনা ২৫ অক্টোবর ঘটে এবং ২৭ অক্টোবর তিনি প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেন।
আইন যা বলছে
বাংলাদেশের কোনো আইনে সরাসরি বলা নেই, যে অভিযান বা তল্লাশির সময় মুঠোফোন পরীক্ষা করা যাবে। বরং সম্প্রতি সরকার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে।
২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৮০ ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীনে কোনো অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজন হলে যদি পুলিশ কর্মকর্তার বিশ্বাস হয় যে কোনো প্রকাশ্য স্থানে এই আইনের পরিপন্থী কিছু ঘটছে বা ঘটেছে, তাহলে তিনি সেই বিশ্বাসের কারণ লিখে সেখানে তল্লাশি করতে পারবেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কোনো বস্তু আটক করতে পারবেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
সম্প্রতি জারি হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় সাইবার হামলা বা কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, ডিজিটাল ডিভাইস ইত্যাদিতে বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে অপরাধের সম্ভাবনা থাকলে পুলিশ কারণ লিখে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারবে। যেমন—ওই স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি করা, তল্লাশির সময় প্রাপ্ত কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা, অপরাধ প্রমাণে সহায়ক দলিল জব্দ করা, ওই স্থানে উপস্থিত ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করা, অপরাধী সন্দেহ হলে গ্রেপ্তার করা এবং তল্লাশির প্রতিবেদন দ্রুত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা।
আইনজীবী যা বলছেন
গণহারে মুঠোফোন তল্লাশি করার আইনগত কোনো সুযোগ নেই; কারণ সংবিধান তা অনুমোদন দেয় না, মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো অপরাধের তদন্তের স্বার্থে যুক্তিসংগত ও আইনানুগ প্রয়োজনে ডিজিটাল ডিভাইস পরীক্ষা করা যেতে পারে, কিন্তু তার সুযোগ সীমিত। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। মুঠোফোন মানুষ ব্যবহার করে আয়রোজগার ও ব্যক্তিগত কাজে। কোনো ওয়ারেন্ট বা আদালতের অনুমতি ছাড়া গণহারে মুঠোফোন চেক করা মানুষের গোপনীয়তার ও চলাচলের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।
স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী আরও বলেন, ‘এ ধরনের তল্লাশি প্রায়ই পুলিশের মনে হওয়ার ওপর নির্ভর করে করা হয়। এই ‘মনে হওয়ার’ ব্যাখ্যা কী—এ প্রশ্ন থেকে যায়। পুরো বিশ্বে নজরদারি প্রবণতা বেড়েছে। ক্ষমতায় থাকা সরকারই এই নজরদারি ব্যবহার করে। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে এ প্রয়োগ হয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এটি অহরহ ব্যবহার করেছে, বর্তমান সরকারের সময়েও হচ্ছে। অথচ মানুষ এই ভয়ের পরিবেশের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছে।’
তিনি বলেন, কোনো এলাকায় বা জরুরি পরিস্থিতিতে তল্লাশির প্রয়োজন দেখা দিলে নাগরিককে আগে জানাতে হবে এবং পুলিশকে কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন