দেশজুড়ে নির্বাচনী সরগরম-আমেজ
| নির্বাচন | গ্রাফিক্স: পদ্মা ট্রিবিউন |
দেশে এখন নির্বাচনের সুর। রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই নির্বাচনমুখী হয়ে উঠেছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও সারাদেশে এখন নির্বাচনী আমেজ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সূত্র জানায়, জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোটসহ নানা ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে বিরোধ ও অভিযোগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছিল। তখন নির্বাচন নিয়ে সংশয়ও দেখা দেয়। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। তাঁদের উদ্যোগে দলগুলো এখন মতভেদ পাশে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মনোযোগী হয়েছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচন হবে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল ইতিমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা তৈরি করেছে, শিগগির তা চূড়ান্ত করবে। এ দুই দলের প্রার্থীরা ইতিমধ্যে মাঠে নেমে গণসংযোগ শুরু করেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) কয়েকজন প্রার্থীর নাম জানিয়েছে।
বিএনপি গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। দলটির নেতারা বলছেন, এটি সম্ভাব্য তালিকা—তফসিল ঘোষণার পর প্রয়োজনে পরিবর্তন আসতে পারে। এর মধ্যে মাদারীপুর-১ আসনের প্রার্থীর নাম আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিএনপির পর এনসিপিও জানায়, তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। জামায়াতে ইসলামীও দ্রুত প্রার্থী তালিকা চূড়ান্তের ঘোষণা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ না থাকায় ভোটের মাঠে সক্রিয় আরও কয়েকটি দল। গণঅধিকার পরিষদ ৫০ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ দল ১৩৮ আসনে, গণসংহতি আন্দোলন ৯১ আসনে, এবি পার্টি ১০৯ আসনে, খেলাফত মজলিস ২৫৬ আসনে, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ২৬৮ আসনে এবং ইসলামী আন্দোলন প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এসব দলের প্রচারণায় সাধারণ মানুষও এখন ভোটের আমেজ পাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, 'বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর দেশের মানুষ এখন নির্বাচনী ট্রেনে উঠে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে এই ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছাবে, এখানে আর কোনো সংশয় নেই।” তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। যতটা ঐকমত্য হয়েছে, তার ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। ১৮ বছর পর মানুষ ভোট দিতে মুখিয়ে আছে।'
জামায়াতে ইসলামী গণভোটের দাবিতে অনড় থাকলেও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি থেকে সরে এসেছে। তারা এখন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পক্ষেই। গতকাল সিলেটে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, 'সবাইকে নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আদায় করব। দেরি হলে নানা ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। আমাদের দাবিই শ্রেষ্ঠ—এটা জনগণ বিবেচনা করবে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করব না।'
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, তাঁদের দলও এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ১৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। গতকাল তিনি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত গাজী সালাহউদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন, 'আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে চাই।'
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ঘোষিত সময় অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, নির্বাচনে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ সেনাসদস্য, দেড় লাখ পুলিশ ও সাড়ে ৫ লাখ আনসার দায়িত্ব পালন করবেন।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য এসেছে। সেনাসদরের জিওসি (আর্টডক) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান বলেন, 'জনগণ যেমন চায়, সেনাবাহিনীও চায় সরকারঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এতে দেশের স্থিতিশীলতা বাড়বে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হবে।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের বিকল্প নেই। তাই নির্বাচনের প্রশ্নে সবার এক জায়গায় আসাকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, 'একটি রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যাওয়া খুব জরুরি। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে দরকার নির্বাচিত সরকার। এই বিবেচনায় নির্বাচনেই স্বস্তি।'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন