[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

বগুড়ায় ফুটপাত দখল, কোটি টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ

প্রকাশঃ
অ+ অ-
বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার রোমেনা আফাজ সড়কে প্রতিদিন রাস্তা দখল করে বসে অর্ধশতাধিক দোকান। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন   

বগুড়া শহরের সার্কিট হাউস-কালীবাড়ি মোড় সড়কে সারি সারি ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের ফাস্টফুড। পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, চিকেন শর্মা, মিটবক্স—সবই মিলছে রাস্তার পাশে। ক্রেতাদের মূলত কিশোর ও তরুণ-তরুণী।

দোকানগুলোতে কোনো আলাদা শেফ নেই। বিক্রেতারাই নিজের হাতে খাবার বানাচ্ছেন ও পরিবেশন করছেন। কারও হাতে গ্লাভস নেই, শরীরে অ্যাপ্রোনও নেই। বিকেল হতে হতে এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানে ভিড় জমতে শুরু করে। কোর্ট হাউস স্ট্রিটের পাশের নামীদামি প্রতিষ্ঠান যেমন ‘পিজ অ্যান্ড বার্গ’, ‘পদ্মা ফুডস’ ও ‘হিলিয়াম রেস্টুরেন্ট’-এ একসময় সন্ধ্যায় ক্রেতার ঢল নামত। এখন সেই ভিড় চলে এসেছে রাস্তার পাশে বসা ভ্যানগুলোতে।

পদ্মা ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জলেশ্বরীতলা ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমদাদ আহমেদ বলেন, ‘অভিজাত এলাকায় একটি খাবারের দোকান খুলতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ লাগে। অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয়। নবায়নেও প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। ভবন ভাড়া, নামি শেফ ও কর্মচারীর বেতন—সব মিলিয়ে খরচ বিপুল। অথচ রাস্তার পাশে ভ্যানে বসা দোকানে বিনিয়োগ মাত্র ৪০–৫০ হাজার টাকা। কোনো অনুমোদন নেই, দোকানভাড়া নেই, কর্মচারীও নেই। শুধু দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতারা সেসব দোকানের দিকে ঝুঁকছেন। এতে সড়ক দখল হয়ে যানজটও বাড়ছে। অভিযোগ করলেও প্রশাসনের কোনো প্রতিকার নেই।’

বগুড়া হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘জলেশ্বরীতলা অভিজাত এলাকা। এখানে দোকান দিতে বিপুল বিনিয়োগ লাগে। নামীদামি দোকানে একটি পিৎজা ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়, কিন্তু ভ্রাম্যমাণ দোকানে ৩০০ টাকায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলেও সস্তা দামের কারণে ক্রেতারা সেখান থেকেই কিনছেন। এতে অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলো লোকসানে পড়ছে। আমরা স্ট্রিট ফুডের বিরোধী নই, তবে এটি অভিজাত এলাকা থেকে সরিয়ে পৌর পার্ক, অ্যাডওয়ার্ড পার্ক সংলগ্ন সড়ক বা সরকারি আজিজুল হক কলেজের পাশে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেছি।’

সম্প্রতি দেখা গেছে, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে সড়কের এক পাশে ২০–২৫টি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান বসেছে। অন্য পাশে আছে ফলের দোকান। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আদালতের সামনে যানজট লেগে থাকে।

এছাড়া পৌরসভা লেন, জেলা খানা মোড়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকী সড়ক, মহিলা ক্লাব মোড়, শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক, সাতমাথা–সার্কিট হাউস সড়কসহ শহরের বিভিন্ন সড়কেই বসছে ফুচকা, চটপটি, জুস, ফাস্টফুড ও ফলের দোকান।

সাতমাথায় প্রতিদিন অর্ধশতাধিক দোকান বসে। জিলা স্কুলের সামনে চটপটি ও কাবাবের দোকানগুলোর চেয়ার ফুটপাত দখল করে রাখা হয়েছে। কবি নজরুল ইসলাম সড়ক, থানা মোড়, বড়গোলা, দত্তবাড়ি, কালিতলা—সব জায়গাতেই দুই পাশে দোকান বসানো হয়েছে। 

রাস্তা দখল করে দোকান বসানোয় বেশির ভাগ সময় যানজটে থাকে শহরে। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন   

জলেশ্বরীতলার ‘জিভে জল’ রেস্টুরেন্টের পরিচালক ফয়সাল চৌধুরী বলেন, ‘প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিত আমাদের ওপর অভিযান চালায়। কিন্তু রাস্তায় বসা ভ্রাম্যমাণ ফাস্টফুড দোকানে কেউ যায় না। পোড়া তেল দিয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে খাবার তৈরি হচ্ছে। তাই নামীদামি রেস্টুরেন্টগুলো লোকসানে পড়ছে।’

‘শখ সিগনেচার রেস্টুরেন্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনাজ ইসলাম বলেন, ‘অভিজাত এলাকা থেকে ভ্রাম্যমাণ দোকান সরানোর দাবি আমরা অনেকদিন ধরেই জানিয়েছি। প্রশাসনের কাছে ধরনা দিলেও কোনো প্রতিকার পাইনি।’

বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক মাসুম আলী বেগ বলেন, ‘সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বসা দোকানই শহরের যানজটের মূল কারণ। পৌরসভা থেকে প্রায়ই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কিছু সময় পর দোকানিরা আবার পসরা সাজিয়ে বসে।’

‘বারবি কিউ রেস্টুরেন্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল বাসেদ বলেন, ‘একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ প্রতিদিন বিকেলে সামনে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসে। এতে আমরা লোকসানে পড়ছি।’

জলেশ্বরীতলা ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বলেন, ‘সড়ক দখল করে দোকান বসালে সব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলাকায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বখাটেদের আড্ডা বাড়ছে, স্কুল-কলেজের মেয়েরা উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছে।’

পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র আমিনুল ফরিদ বলেন, ‘সড়ক ও ফুটপাত দখল করে এসব দোকান বসায় শহরে দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে। পথচারীরা দুর্ভোগে পড়েন। এসব দোকান বসানোর পেছনে কোটি টাকার চাঁদাবাজি আছে।’

বগুড়া আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল বাছেত বলেন, ‘সড়কে দোকান বসে শহর অচল হয়ে যাচ্ছে। যদি চাঁদাবাজি না থাকে, তাহলে প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’

খোঁজে জানা গেছে, শহরের বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাতে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার অস্থায়ী দোকান বসে। প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। বছরে এ অঙ্ক দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকায়। অভিযোগ আছে, এই টাকা রাজনৈতিক নেতা, পৌরসভার কিছু কর্মকর্তা ও পুলিশের কাছে ভাগ হয়। কেউ মাসিক, কেউ দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা তোলেন।

তবে বগুড়া সদর ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে বসা দোকান থেকে পুলিশ কোনো চাঁদা নেয় না। কেউ পুলিশের নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তুললে আমাদের কাছে জানান। নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান হয়, কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই আবার বসে যায়।’

ট্রাফিক পরিদর্শক (প্রশাসন) সালেকুজ্জামান বলেন, ‘ফুটপাত ও সড়ক মুক্ত রাখতে ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালায়। তবে অভিযান শেষে দোকানিরা আবার বসে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশ কোনো চাঁদা নেয় না।’ 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন