[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

দেশজুড়ে বেড়েছে গুলি করে হত্যার ঘটনা

প্রকাশঃ
অ+ অ-
আগ্নেয়াস্ত্র | প্রতীকী ছবি

রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক খুনোখুনি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গুলি করে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। সর্বশেষ সোমবার পুরান ঢাকায় দিনের বেলা মানুষের সামনে গুলি করে একজনকে হত্যা করা হয়। নিহত তারিক সাইফ মামুনও ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, অপরাধীদের হাতে এখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র আছে। গণঅভ্যুত্থানের সময় এবং পরে অনেক অস্ত্র-গুলি সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায়। পুলিশের লুট হওয়া ১ হাজার ৩৪২টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের সংঘর্ষে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।

গত বুধবার রাতে চট্টগ্রামে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর জনসংযোগে গুলি চালানো হয়। এতে একজন নিহত হন এবং প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। শুধু এটিই নয়; গত এক মাসে চট্টগ্রামে গুলিতে দুই রাজনীতিকসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আর গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় খুন হয়েছেন ৩৫ জন। তাঁদের মধ্যে ২২ জন গুলিতে খুন হয়েছেন। বাকি ব্যক্তিদের পিটিয়ে বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্তত ১৫টি হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধের কারণে।

এ ছাড়া গত ১৫ মাসে খুলনায় ৪১ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫টিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। একই সময়ে বগুড়ায় ৮৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে দুটিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতার সম্ভাবনা মাথায় রেখে পুলিশ দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। আর যেসব গুলির ঘটনা ঘটছে, সেগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রামে একের পর এক গুলি
চট্টগ্রামে গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনী জনসংযোগের সময় পিস্তল ঠেকিয়ে সারোয়ার হোসেন বাবলাকে গুলি করে এক সন্ত্রাসী। ঘটনাস্থলেই বাবলা নিহত হন। এর আগে ২৫ অক্টোবর বিকেলে চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে যুবদলকর্মী আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় তাঁর আত্মীয় মুহাম্মদ রিয়াদও গুলিবিদ্ধ হন। গত ৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আবদুল হাকিম। তিনি রাউজানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত ৬ জুলাই দুপুরে রাউজানে প্রকাশ্যে গুলি করে যুবদলকর্মী মো. সেলিমকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে চারজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে ঘটনার দিন শিপন মিয়া এবং দুদিন পর ইয়াছিন মারা যান।

খুলনায় গত ১ অক্টোবর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশায় ঘুমন্ত অবস্থায় তানভীর হাসান শুভকে (২৯) গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বর রূপসার নৈহাটিতে ইমরান হোসেন মানিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন অনিক নামে এক যুবক। তার আগে আগস্টে খুলনা মহানগরীতে পাঁচজন এবং জুলাইয়ে দুজন খুন হন। এভাবে খুলনায় গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে ৪১টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।

এদিকে, গত ১৬ জুলাই রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং এলাকায় মো. ইব্রাহিম নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাত ৯টার দিকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে আল আমিন নামের আরেক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এর আগে ২৫ মে রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ২০ মার্চ রাতে গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনে সুমন মিয়া নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার কাজ করতেন। ৩১ মার্চ সাভারে মো. রুবেল নামের এক নিরাপত্তাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ১ আগস্ট মহাখালীতে মুখোশপরা দুই ব্যক্তির গুলিতে আহত হন বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা জামাল হোসেন।

বেপরোয়া ডাকাত-ছিনতাইকারী
দেশের নানা এলাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা কিছু সন্ত্রাসী দলের হাতেও দেখা যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। চাঁদাবাজি বা লুটপাটে বাধা পেলেই তারা গুলি ছুড়ছে। সম্প্রতি আলোচনায় আসে রাজশাহী-কুষ্টিয়া অঞ্চলের ডাকাত দল ‘কাকন বাহিনী’। তাদের প্রধান হাসানুজ্জামান কাকনের সহযোগীরা স্পিডবোট নিয়ে পদ্মা নদীতে দাপিয়ে বেড়ায় এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। গত ১৩ অক্টোবর দলটির সদস্যরা প্রায় অর্ধশত গুলি ছোড়ে পাবনার ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের ইসলামপাড়া এলাকায়। ২৭ অক্টোবর তারা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মার চরে দুই কৃষককে গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় আরও দুজন গুলিবিদ্ধ হন।

রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, কাকন ও তার সহযোগীদের ধরতে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে খুলনায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হুমায়ুন কবির ওরফে হুমার বাহিনী। প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে তার সহযোগীরা। সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর তারা দুটি বাড়িতে ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। একই সঙ্গে চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিমুল ভুঁইয়ার সমর্থনে থাকা মুন্না বাহিনীও এলাকায় বেপরোয়া।

এর আগে রাজধানীতেই গুলি করে ছিনতাইয়ের কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ১২ অক্টোবর ভোরে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় নাফিস আজিজ সিদ্দিক নামে এক যুবককে গুলি করে মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ২৭ মে সকালে মিরপুর ১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পেছনের গলিতে প্রকাশ্যে গুলি করে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর ২২ লাখ টাকা এবং বিদেশি মুদ্রা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার ২০ দিন পর ডিবি ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে এবং লুট হওয়া টাকার একটি অংশ উদ্ধার করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বনশ্রী এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে প্রচুর স্বর্ণালংকার লুট করা হয়।

অভিযানে ধরা পড়ছে অস্ত্র
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত ও বিশেষ অভিযানে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ছাড়াও প্রচুর অবৈধ অস্ত্র ধরা পড়ছে। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে বনলতা এক্সপ্রেস থেকে আটটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। ট্রেনের একটি বগি তল্লাশি করে পিস্তল ছাড়াও ১৪টি ম্যাগাজিন, ২৬ রাউন্ড গুলি, ২ দশমিক ৩৯ কেজি গানপাউডার এবং ২ দশমিক ২৩ কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক পাওয়া যায়। তখন সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে এখনও এসব অস্ত্র-গুলির উৎস বা গন্তব্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন।

গত ৬ নভেম্বর আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৩০ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত আট দিনে সেনাবাহিনী ৯টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, সাতটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ১২ রাউন্ড বিভিন্ন ধরনের গুলি, ১৮টি ককটেল এবং ২৩টি পেট্রোল বোমা উদ্ধার করেছে। এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর সেনাসদরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এক মাসে ৬৫টি অবৈধ অস্ত্র এবং ২৯৭টি গুলি উদ্ধার করে সেনাবাহিনী। একই সময়ে হারানো ৯ হাজার ৭৯৪টি অস্ত্র এবং দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩৫৯টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

র‍্যাব-১১ গত ১ নভেম্বর জানায়, নরসিংদীর রায়পুরায় অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাছে পাওয়া গেছে দুটি বিদেশি পিস্তল, ছয়টি দেশি বন্দুক, একটি দোনলা বন্দুক, দুটি এলজি, পাঁচটি পাইপগান, তিনটি ম্যাগাজিন এবং ৮২ রাউন্ড গুলি। গত ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে র‍্যাবের অভিযানে এক বিএনপি-কর্মীর বাড়ি থেকে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে আছে ১০টি বন্দুক, একটি এয়ারগান, ১৫টি কিরিচ, চারটি রামদা, ১১টি কার্তুজ এবং তিনটি চায়নিজ কুড়াল। গত ৯ সেপ্টেম্বর রংপুরের তাজহাট থানা এলাকায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযানে ১০টি একনলা বন্দুক এবং ৩৬ রাউন্ড রাবার কার্তুজ উদ্ধার হয়।

তাজহাট থানার ওসি শাহজাহান আলী বলেন, বাগানের ভেতর কারা, কেন অস্ত্র-গুলি জমা করেছিল— তা এখনো জানা যায়নি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

উদ্ধার হয়নি পুলিশের ১,৩৪২ অস্ত্র
পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, ২০২৪ সালে পুলিশের পাঁচ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ছয় লাখ ৫২ হাজার আটটি গুলি লুট হয়। এর মধ্যে চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত চার হাজার ৪২১টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৪২টি। গুলির ক্ষেত্রে উদ্ধার হয়েছে তিন লাখ ৯৪ হাজার ৭২১টি। বাকি গুলির খোঁজ এখনো মেলেনি।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন