অপেক্ষার শেষ, আজ রায় পাচ্ছেন শেখ হাসিনা
| শেখ হাসিনা |
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ের জন্য অপেক্ষা এখন প্রায় শেষ।
সোমবার সকালে পরে যেকোনো সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মামলার অন্য অভিযুক্তরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। সাবেক পুলিশ প্রধান এখন অবশ্য রাজসাক্ষী।
যেহেতু শেখ হাসিনা ও কামাল পলাতক, তাই বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ যখন রায় দেবেন, তখন অভিযুক্তদের মধ্যে কেবল মামুনই কাঠগড়ায় থাকবেন। কারণ তিনি এখন পুলিশ হেফাজতে।
রায় কী হতে পারে, অভিযুক্তদের সাজা কেমন হতে পারে, ট্রাইব্যুনাল কী বলবে—এসব নিয়ে এখন সবার মধ্যে নানা আলোচনা। দেশের মানুষের দৃষ্টি এখন ট্রাইব্যুনালের দিকে।
ভারত সরকারের দেওয়া নিরাপত্তায় শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে থাকছেন। তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও দেশটির কোথাও লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হয়। দুজনের বিরুদ্ধেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
শেখ হাসিনা প্রথম বাংলাদেশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ—হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন, গুমসহ নানা অভিযোগে বিচার চলছে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় দমন–পীড়নের সময় ১ হাজার ৪০০ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর তথ্য উঠে আসে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট–ফাইন্ডিং মিশন নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি, টিয়ার গ্যাস ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকারের দমন ছিল ‘চরম অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে’।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই দমন–পীড়ন মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কীভাবে শেখ হাসিনা নিজেই ক্ষমতা ধরে রাখতে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ও আশপাশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চারপাশে নিরাপত্তা জোরদার করতে সেনা সদর থেকে সহায়তাও চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন—এমন আশঙ্কায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
নাগরিকদের হত্যার উদ্দেশ্যে অগ্নিসংযোগ বা ককটেল হামলার চেষ্টা হলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০২৪ সালে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার সরকারই গঠন করেছিল একাত্তরের অপরাধীদের বিচারের জন্য।
এই ট্রাইব্যুনালেই শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
গত জুনে রাষ্ট্রপক্ষ শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়, যেখানে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, শেখ হাসিনা বিক্ষোভকারীদের ওপর কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন—এ প্রমাণ তাদের হাতে আছে। আসামিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, এবং শেখ হাসিনা ও কামালের জন্য মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হচ্ছে।
তবে সাবেক আইজিপি মামুন যেহেতু রাজসাক্ষী, তাই তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আদালতের ওপরই ছেড়ে দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘উসকানিমূলক’ মন্তব্য করেছিলেন, যা গণপ্রতিবাদের জন্ম দেয়। এই প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও সরাসরি গুলি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগপত্রে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় বিক্ষোভকারীকে গুলি করা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার বিস্তারিত আছে।
গত ১০ জুলাই এক শুনানিতে সাবেক আইজিপি মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেন।
তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগগুলো সত্য। আমি দায় নিচ্ছি এবং দোষ স্বীকার করছি।’
তিনি ‘সত্য প্রকাশ করতে’ আদালতকে সহায়তা করার ইচ্ছাও জানান।
তবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের দাবি, তারা নির্দোষ। তিনি দুজনের খালাস চেয়েছেন।
হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনামলে গুম, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় আরও দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে দমন–পীড়নের অভিযোগও আছে, যেখানে তিনি প্রধান অভিযুক্ত।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বলেন, ‘রায়টি বিটিভিতে সরাসরি প্রচার হবে এবং ট্রাইব্যুনালের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেও দেখানো হবে।’
নারী হিসেবে শেখ হাসিনা কোনো বিশেষ সুবিধা পাবেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সাধারণ আইনে জামিনের ক্ষেত্রে নারী, অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অসুস্থদের কিছু অগ্রাধিকার থাকে। আইসিটি আইনে এমন কিছু নেই। রায় সম্পূর্ণভাবে অভিযুক্ত অপরাধের গুরুত্বের ওপরই নির্ভর করবে।’
প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামও ট্রাইব্যুনালে সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে প্রসিকিউটর ও বিশেষ তদন্তকারী তানভীর হাসান জোহা আশা প্রকাশ করেন, শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
Comments
Comments