[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সুন্দরবনে জলদস্যুর আতঙ্ক ফের

প্রকাশঃ
অ+ অ-
সুন্দরবনে মাছ শিকার করেছেন এক জেলে | ফাইল ছবি 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে আবার ভয়াবহ জলদস্যু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দস্যুচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অধিকাংশই পুরোনো দস্যু বা জেল থেকে পালানো অপরাধী।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনকে ঘিরে এখন কমপক্ষে ৯টি জলদস্যু গ্রুপ কাজ করছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ পর্যন্ত হতে পারে।

সূত্র বলছে, এই গ্রুপগুলো একটি সংগঠিত চাঁদাবাজি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ‘নিরাপত্তা চাঁদা’ নামে তারা জেলেদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নেয়। যারা টাকা দেয়, তাদের বনাঞ্চলের জলসীমায় মাছ ধরতে দেওয়া হয়। যারা দেয় না, তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়।

জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মাছের প্রজনন মৌসুমে তিন মাস নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনে প্রবেশ উন্মুক্ত হওয়ার পর দুই মাসে জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ দেওয়ার ঘটনা বাড়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা ভয়ে অনেক সময় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেয় না, তাই প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনে ৩২টি জলদস্যু দলের ৩২৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। তারা তখন ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২৫০৪ রাউন্ড গুলি জমা দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করে।

কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ জলদস্যু ও সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সময়ে ৪৮ জন জেলেকে জলদস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অভিযানের ফলে জলদস্যুদের কর্মকাণ্ড অনেকটা কমেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কোস্টগার্ডের গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনে বর্তমানে সক্রিয় দস্যু গ্রুপগুলো হলো- করিম শরীফ বাহিনী (দলনেতা: মো. করিম শরীফ), জাহাঙ্গীর বাহিনী (দলনেতা: জাহাঙ্গীর), দয়াল বাহিনী (দলনেতা: আলিফ মোল্লা দয়াল), দুলাভাই বাহিনী (দলনেতা: রবিউল ইসলাম), ছোট সুমন বাহিনী (দলনেতা: সুমন), হান্নান বাহিনী (দলনেতা: হান্নান), রাঙ্গা বাহিনী (দলনেতা: রাঙ্গা) এবং ছোটন বাহিনী (দলনেতা: ছোটন)।

কোস্টগার্ডের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় সুন্দরবনের পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বড় কোনো সক্রিয় দস্যু চক্র এখন নেই, তবে কিছু ছোট দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।' 

কোস্টগার্ডের কর্মকর্তারা জানান, দস্যুরা নিয়মিতভাবে আস্তানা বদলায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা একাধিক অভিযানে তাদের ঘাঁটি ধ্বংস করেছি। বনভিত্তিক অভিযানে তারা এখন কোণঠাসা, আশা করি শিগগিরই সুন্দরবন আবার দস্যুমুক্ত হবে।'

জানা গেছে, জলদস্যুরা চাঁদা আদায়, অপহরণ ও ডাকাতিতে সাধারণত স্থানীয়ভাবে তৈরি একনলা বা দু’নলা বন্দুক, এয়ারগান, শটগান, দা, চাপাতি ও ছুরি ব্যবহার করে। 

খুলনা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, 'আমাদের নৌবাহিনী টহলে আছে, কোস্টগার্ড সতর্ক রয়েছে, নদী পুলিশও কাজ করছে। কোনও ঘটনা ঘটলেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।' 

জলদস্যুদের তৎপরতা নিয়ে অভিযোগ এসেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।' 

বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে তিনটি মূল গ্রুপ সক্রিয়। এগুলো হলো—শরীফ গ্রুপ, জাহাঙ্গীর গ্রুপ, এবং আসাদ গ্রুপ।

তিনি বলেন, 'বন উন্মুক্ত হওয়ার পর কিছু জেলে অপহৃত হয়েছেন, মুক্তিপণের বিনিময়ে কয়েকজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই।' 

তিনি আরও বলেন, 'জেলেরা ভয় পায়, তাই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে না বা কাউকে জানায় না। নিজেরাই বিষয়টা সামলায়, কারণ তাদের আবার বনেই ফিরতে হয়।' 

উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করা টেলিভিশন সাংবাদিক মোহসিন উল হাকিম বলেন, 'সুন্দরবনে এখন ছয় থেকে সাতটি দল সক্রিয়। তারা মূলত জেলেদের কাছ থেকে আগাম টাকা নেয়। যারা টাকা দেয়, তারা নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারে। কিন্তু কেউ টাকা না দিলে, তাদের অপহরণ করে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।' 

তিনি আরও বলেন, 'সাধারণত সুন্দরবনের জলদস্যুরা স্থলভাগে আসে না। যদি কোনও গ্রুপকে তীরে দেখা যায়, তাহলে তারা হয়তো পালিয়ে বেড়ানো কোনও গোষ্ঠী, বনভিত্তিক নিয়মিত দস্যু নয়।' 

কোস্টগার্ড পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করলেও তাদের কাজ নিয়ে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বনজীবী বলেন, 'কোস্টগার্ডের ভূমিকা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সময় তাদের অভিযান শুধু দেখানোর জন্য হয়।' 

আরেকজন অভিযোগ করেন, 'জাহাঙ্গীর বাহিনীর সদস্যরা জেলেদের অপহরণ করে। মুক্তিপণ নেওয়ার পর কোস্টগার্ড গিয়ে দেখায় যেন তারা তাদের উদ্ধার করেছে।' 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন