দুই দিনে কোনো পর্যটক সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে পারেননি, জাহাজ চলাচল অনিশ্চিত
![]() |
| নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে নেই পর্যটক। আজ রোববার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে সরকার। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, কক্সবাজার থেকে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবেন। কিন্তু দুই দিনে একজন পর্যটকও যেতে পারেননি, কারণ পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। কবে থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হবে, তা নিয়েও নিশ্চিত কেউ বলতে পারছে না।
কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার কথা। এজন্য ১ হাজার ৭০০ জন ধারণক্ষমতার দুটি জাহাজ—এমভি কর্ণফুলী ও এমভি বার আউলিয়া—চলাচলের অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু শনিবার ও রোববার ওই রুটে কোনো জাহাজ চলেনি। আরও চারটি জাহাজ চলাচলের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা শুধুমাত্র দিনের বেলায় সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণ করতে পারবেন, রাত যাপন করা যাবে না। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাতযাপনের সুযোগ থাকবে। বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকতে হবে। কিউআর কোডবিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষা করতে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ করা, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা বিক্রি, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা নিষিদ্ধ। সৈকতে মোটরসাইকেল বা সি-বাইকসহ মোটরচালিত যান চলাচলও বন্ধ। এছাড়া নিষিদ্ধ পলিথিন বহন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, পানির বোতল ইত্যাদি) ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
আজ সকাল সাতটায় নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কোনো যাত্রী নেই। বাঁকখালী নদীতেও কোনো পর্যটকবাহী জাহাজ দেখা যায়নি। ঘাটে অবস্থান করছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তর ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। জানা গেছে, গতকাল সকালে তিনজন পর্যটক টিকিট কেটে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জাহাজ না থাকায় ফিরে যেতে হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য সেন্ট মার্টিন উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় গত দুই দিনে কোনো পর্যটক যেতে পারেননি। নভেম্বরে দিনে গিয়ে দিনে ফেরার নিয়ম থাকায় সময় ও সুযোগ কম, আবার দীর্ঘ জাহাজযাত্রার কারণে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তারপরও আমরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঘাটে অবস্থান করছি।’
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, টানা ৯ মাস বন্ধ থাকার পর ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে উখিয়ার ইনানী নৌবাহিনীর জেটিঘাট কিংবা টেকনাফের কোনো স্থান থেকে এখনো জাহাজ চলাচলের অনুমতি নেই।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে।
![]() |
| গত ডিসেম্বরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে কক্সবাজারের পথে পর্যটকবাহী একটি জাহাজ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দুই দিন ধরে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন আসা-যাওয়ায় এক জাহাজের জ্বালানি, কর্মচারীর বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ প্রায় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু টিকিট বিক্রি থেকে সর্বোচ্চ দেড়-দুই লাখ টাকা আসে। দিনে সাত-আট লাখ টাকা লোকসান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পুরো নভেম্বর মাস জাহাজ চালানো হবে না। তবে ইনানী বা টেকনাফ থেকে চালানোর অনুমতি দিলে কাল থেকেই জাহাজ চলতে পারবে। তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে।’
হোসাইন ইসলাম বাহাদুর আরও বলেন, অনুমোদন পাওয়া এমভি কর্ণফুলী ও বার আউলিয়া বর্তমানে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় নোঙর করা আছে। সেখান থেকে কক্সবাজারে আসতে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।
ঢাকার কমলাপুর এলাকার চার যুবক গতকাল সকালে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কক্সবাজারে আসেন। কিন্তু শহরের কোথাও জাহাজের টিকিট পাননি। তাঁদের একজন, সাজ্জাদুল ইসলাম (৩৪), বলেন, ‘জাহাজ না থাকায় কোথাও টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য কোনো নৌযানেও যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার বা জাহাজ মালিকদের পক্ষ থেকে আগে থেকে জানানো হলে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।’
আজ দুপুরে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে কথা হয় ঢাকার সদরঘাটের ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুনের (৪৮) সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ে। তিনি বলেন, ‘গত বছর কর্ণফুলী জাহাজে সেন্ট মার্টিন গিয়েছিলাম। সকাল সাতটায় কক্সবাজার থেকে ছাড়ে, বেলা দুইটার দিকে দ্বীপে পৌঁছায়, বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ফিরে আসে। হাতে সময় থাকে মাত্র দেড় ঘণ্টা—তার মধ্যে ভ্রমণ, খাওয়াদাওয়া ও কেনাকাটা করা যায় না। রাতযাপনের সুযোগ না থাকলে কক্সবাজার থেকে পর্যটকেরা আর আগ্রহী হবে না।’
সেন্ট মার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, ‘পর্যটক বরণে আমরা প্রস্তুত। কোটি টাকা খরচ করে হোটেল-রিসোর্ট সংস্কার করেছি। কিন্তু রাতযাপনের সুযোগ না থাকায় পর্যটকেরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। পুরো নভেম্বর যদি পর্যটক না আসেন, দ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ ক্ষতি হবে। পরিবেশ রক্ষা জরুরি, তবে স্থানীয় লোকজনের জীবিকা ও বিনিয়োগকারীদের টিকিয়ে রাখার বিষয়টিও দেখতে হবে।’
সেন্ট মার্টিন দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি মৌলভি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘তিন বছর আগে টেকনাফ থেকে প্রতিদিন ৯-১১টি জাহাজে পাঁচ-ছয় হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করত। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত, আরাকান আর্মির দখল, নাফ নদীতে গুলিবর্ষণ ও অপহরণের ঘটনার কারণে টেকনাফ রুট বন্ধ হয়ে যায়। তাই গত বছর থেকে কক্সবাজার রুটে জাহাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।’


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন