[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সরাসরি গুলির নির্দেশ, মানবাধিকারকর্মীদের কড়া সমালোচনা

প্রকাশঃ
অ+ অ-
অস্ত্র হাতে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা | ফাইল ছবি

গত সপ্তাহে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। ওয়্যারলেসে এক বার্তায় সিএমপি পুলিশ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন তিনি। একইভাবে গত রোববার ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। পুলিশ সদস্যদের এমন নির্দেশ দেওয়ার পর মানবাধিকারকর্মীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এটি অপরাধকে উসকে দেওয়ার মতো বার্তা।

গত মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় ওয়্যারলেস সেটে টহল ও থানা পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘দেখামাত্র ব্রাশফায়ার নিরস্ত্র জনসাধারণের জন্য নয়। যার হাতে অস্ত্র নেই, তার ওপর তো আর এসএমজি ব্যবহার করবো না। সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী যারা, তাদের জন্য এই নির্দেশনা। আমার এলাকায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা খুন করে গেলো (বায়েজিদের চালিতাতলী)। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে তারা যেন আর সাহস না পায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চট্টগ্রাম নগরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা যেন স্বপ্নেও এটি কল্পনা করতে না পারে, সে কারণেই এই ব্যবস্থা।’

একইভাবে রোববার বিকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ওয়্যারলেস বার্তায় ডিএমপির মাঠপর্যায়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার কথা বলেছি। যারা মানুষ বা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন—আইনসম্মতভাবেই তাঁদের ওপর গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়ার পর দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে যে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার ঘটনা ঘটছে, তা অবশ্যই উদ্বেগজনক। কিন্তু এর মধ্যে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নির্দেশ। এ ধরনের নির্দেশ শুধু দায়িত্বহীনই নয়, এটি দেশের সংবিধান, মানবাধিকার এবং আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থি।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনবহির্ভূতভাবে গুলি করার নির্দেশ এসব অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইন, দণ্ডবিধি কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির কোনো ধারাই ‘দেখামাত্র গুলি’ করার অনুমতি দেয় না। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পেশাদারত্বের মূলনীতি হলো—অভিযুক্ত অপরাধী হলেও তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা।

মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য মানবাধিকারবিরোধী। যে হামলা করবে বা বোমা মারবে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কয়েকটি মৌলিক নীতিমালা আছে—কোন পরিস্থিতিতে কতটা ব্যবহার করা যাবে, কোন জায়গায় সমানুপাতে গুলি করা যাবে, সেটার নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার কথা। সেই নীতিমালা না মেনে ওয়্যারলেসে সিএমপি কমিশনার বলেছেন ব্রাশফায়ার করতে। আর এখন ডিএমপি কমিশনার বললেন গুলি চালাতে। এটি নিঃসন্দেহে মানবাধিকার হরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মানবাধিকার হরণের প্রবণতা নতুন বাংলাদেশে বা স্বাধীন বাংলাদেশে থাকা উচিত নয়। এটি অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের রাজনীতিকে উসকে দেয়। তারা এটি করতে পারেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, তাদের মনে রাখতে হবে—এই ধরনের ঘোষণা যখন দেন, তখন বাংলাদেশে ইতোমধ্যে চার হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিগত ১৭ বছরে। আগে হিসাব করলে পাঁচ হাজারের বেশি হবে। বাংলাদেশের সীমান্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, সেখানে দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া আছে। এরকম বাস্তবতায়, যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঝুঁকি আছে এবং আজও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, সেই মুহূর্তে আরেকটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের রাজনীতির কথা বলা নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক। এটি মানবাধিকার হরণের সুযোগ বাড়াবে এবং আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক নীতির বিরোধী অবস্থানে নিয়ে যাবে।’

মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘জননিরাপত্তার নামে বিচারবহির্ভূত বলপ্রয়োগের বৈধতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন নির্দেশ শুধু সহিংসতাকে উসকে দেয়, জবাবদিহি এড়িয়ে যায় এবং নাগরিকদের মধ্যে ভয়–অনিশ্চয়তা বাড়ায়।’

তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘রাষ্ট্র যদি নিজেই আইনের বাইরে গিয়ে আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোন ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যেকোনো সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ। নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, তবে সেটা হতে হবে প্রমাণ, তদন্ত ও আদালতের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব জনগণকে রক্ষা করা, আতঙ্কিত করা নয়। মানবাধিকার ও সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোই আমাদের নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করবে, অন্য কোনো পথে নয়।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব বলেন, ‘তাদের এমন সিদ্ধান্ত অন্যায় এবং সংবিধানবিরোধী। এটি কোন বৈধ সরকারের সময়ের বক্তব্য হতে পারে না। তারা এটি বলে প্রমাণ করেছে যে আইনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই। এটি স্বৈরশাসনের সময়ও দেখা গেছে। একটি মামলার রায়ে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা সরাসরি গুলি না করেও সাজা পেয়েছেন। যেখানে বিচার করে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে, সেখানে পুলিশ তাঁদের নিজেদের আইন বা সংবিধান ভঙ্গ করে দেশের সব আইন ভেঙেছে। এটি বাংলাদেশকে মানায় না।’

গত মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনার ব্রাশফায়ারের নির্দেশ দেওয়ার পর আইন ও সালিশ কেন্দ্র উদ্বেগ জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, এই ধরনের নির্দেশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করার শামিল, যা সংবিধান, আইনের শাসন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং আইনের আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন অপরাধীকেও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হত্যা বা গুলি চালানোর নির্দেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জোর দিয়ে বলছে, এই ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সদস্যদের মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। সরকারকে জানাতে হবে—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুলি চালানোর নির্দেশ রাষ্ট্রের নীতি ও আইনি কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা। চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের এ ধরনের বক্তব্য দায়িত্বশীল প্রশাসনিক আচরণের পরিপন্থি এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে। আসকের মতে, এই বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে এমন নির্দেশ বা মনোভাব ভবিষ্যতে প্রাণহানি ও বিচারবহির্ভূত ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের জন্য ক্ষতিকর।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন