হয়রানির জালে জামায়াত ও এনসিপি নেতারাও
![]() |
| প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হাজারো মানুষ | ফাইল ছবি |
গত বছরের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা মামলাগুলো যেন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য নিরীহ মানুষকে এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে, এমনকি ঘটনাস্থলের সঙ্গে দূরের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অনেককে আসামি করা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া কয়েকজনের নামও মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কিছু নেতা এসব মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে হত্যার ও আহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১ হাজার ৬০১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলায় ১০ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। কেবল ঢাকাতেই ৫০টি থানায় ৭৪৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের সঙ্গে বিক্ষোভ বা রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কেউ কেউ তো ওই সময় দেশে ছিলেনই না।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বঙ্গবাজারের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী জামায়াত নেতা সোহানুর রহমান আজাদ ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পরে ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা রিয়াজ হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। চলতি বছরের ১৩ মার্চ পুলিশ তাকে বঙ্গবাজারের নিজ দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে। গত ২৮ মে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান সিকদার পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। প্রায় চার মাস কারাগারে থাকার পর আজাদ জামিনে মুক্তি পান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, আজাদ জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে দেখা গেছে তাকে। পুলিশ রিমান্ডের আবেদনে আজাদকে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ এলাকার কৃষক লীগের কর্মী হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। যে মামলায় আজাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেটি দায়ের করেছিলেন নিহত রিয়াজের মা সাফিয়া বেগম। ৯ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি থানায় করা মামলায় আজাদকে ১৩২ নম্বর আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
আজাদের ছোট ভাই গোলাম কিবরিয়া বিএনপির বাংলাবাজার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, গত বছরের ৩ আগস্ট কবি নজরুল কলেজের কাছে বিক্ষোভে তিনি নিজেই পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়েছিলেন। তার ভাই আজাদও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরও কেন আজাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলা এবং রিমান্ড স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে। আজাদের অনেক পরিচয় রয়েছে এবং তিনি একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত।'
আজাদের দলীয় সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। তবে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি সাড়া দেননি।
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহসানুল মাহবুব জুবায়েরকেও জুলাই মাসের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে। গত বছরের ২০ জুলাই গাজীপুরে গুলিতে আহত হওয়া জাহিদুল ইসলাম গত ২৫ জানুয়ারি গাজীপুর মহানগর হাকিম আদালতে ২২৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। সেখানে জুবায়েরকে ৯৮ নম্বর আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
উত্তরায় একটিবোয়িং হাউসের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত জুবায়ের দাবি করেন, ‘স্থানীয় দুজন বিএনপি নেতার চাঁদাবাজি প্রত্যাখ্যান করার কারণে তিনি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।’
তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় বিএনপি নেতারা প্রতিশোধ হিসেবে এই হত্যাচেষ্টা মামলায় তার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পরও দেশে হয়রানিমূলক মামলা হচ্ছে। এতে প্রকৃত ভুক্তভোগীও ন্যায়বিচার পাবেন না। আশা করি আদালতে এই মামলা টিকবে না। কিন্তু হাজিরা দিতে আমাকে আদালতে যেতে হবে কেন?’
মামলার নথিতে বাদীর ফোন নম্বর নেই, এবং যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেই এলাকার বাসিন্দারা বাদীকে চেনেন না।
গত বছর জুবায়েরের মামা কানাডার নাগরিক ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মনির উদ্দিনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুটি মামলা উত্তরা পশ্চিম থানায় এবং একটি উত্তরা পূর্ব থানায়। জুলাই আন্দোলনের সময় মনির কানাডাতেই ছিলেন। তিনি আহত আন্দোলনকারীদের খাবার ও চিকিৎসার খরচের জন্য তার ভাগ্নের কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন। ইউনূস সরকার গঠনের পর তিনি রাষ্ট্রের কোষাগারে তিন লাখ টাকা অনুদানও দেন। মনির উদ্দিনের তিন ভাই এবং বর্ধিত পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার ভাইয়েরা ঢাকা, গাজীপুর ও উত্তরা এলাকায় থাকেন, আর বোন ও ভগ্নিপতি ফেনী জেলা জামায়াত ইউনিটে সক্রিয়। অনেকে বিস্মিত হয়েছেন, বিদেশে থাকলেও মনিরের নাম জুলাইয়ের মামলাগুলোয় এসেছে।
মনিরের দাবি, বিএনপির কর্মীরা তার কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করেছিল। চাঁদা না পেয়ে তার বিরুদ্ধে এসব মামলা করেছে।তিনি পুলিশ সদর দপ্তর, আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে বিষয়গুলো জানিয়েছেন। প্রয়োজনে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকেও জানাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক মামলার বাদী আসাদুল্লাহ নীরব জানান, তিনি মনিরকে আসামি হিসেবে নাম দিলেও বাস্তবে চেনেন না।
আহত জুলাই আন্দোলনকারী ও এনসিপির সংগঠক তারিকুল ইসলাম সম্রাটও এর মতো একটি ঘটনা। মকবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তির দায়ের করা উত্তরা পশ্চিম থানার মামলায় তাকে ২১০ নম্বর আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সম্রাট আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, তারপরও তার নাম একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় যুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তার পরিবারের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধে হেরে যাওয়া এক ব্যক্তি গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির যোগাযোগ ব্যবহার করে তাদের জমি দখলের চেষ্টা করেছে। ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ঢাকায় একাধিক মামলা করেছেন, যেখানে সম্রাট ও তার আত্মীয়দের জুলাই সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বাদী সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, সম্রাট আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন কিনা তিনি জানেন না। এছাড়া বলেন, ‘আসামিকে নামে চিনব না। দেখলে হয়তো চিনতে পারি।’
সদরঘাটে গত বছরের ২৭ মার্চ দায়ের করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ২৯৭ নম্বর আসামি হিসেবে নাম রয়েছে ফাহিম ফয়সাল সৌরভের (২৮)। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও জামায়াত কর্মী। ২০২১ সালে জামায়াতে যোগদানের আগে ছাত্রলীগে ছিলেন এবং কোটা সংস্কার ও এক দফার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
সৌরভ মনে করেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই তার নাম এসব মামলায় জড়িয়েছে। তিনি মনে করেন, সঠিক তদন্তের পরই মামলা করা উচিত।
এই মামলায় বাদী যে ফোন নম্বর ব্যবহার করেছেন সেটি বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
সৌরভের চাচা মাসুদ শেখের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তিনিও আন্দোলন-সংক্রান্ত একটি মামলায় দুই মাস জেলে ছিলেন। তিনি জানান, জমি সংক্রান্ত বিরোধে জড়িত স্থানীয় প্রতিপক্ষরা তার নাম মামলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।
মাসুদ শেখের কোনো পদ-পদবি আছে কিনা জানতে চাইলে বাদী জাহিদুল ইসলাম জুনু বলেন, ‘মাসুদ শেখের কোনো পদ নেই, তবে আওয়ামী লীগের লোকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল।’
জুলাই আন্দোলনে হামলায় মাসুদ শেখের কোনো ভিডিও প্রমাণ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তখন দৌড়ে আমরা পালিয়ে যাই। আমার কাছে কোনো ভিডিও ফুটেজ নেই, তখন ভিডিও করা সম্ভব ছিল না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহকারী আইন বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, ‘দল কাউকে ব্যক্তিগতভাবে মামলা করার নির্দেশ দেয়নি। যদি কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে নিরীহ মানুষকে জড়ায়, তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। এর দায় বিএনপি নেবে না।’
জুলাই হত্যা ও হত্যাচেষ্টা কেন্দ্রিক প্রায় ২০০ মামলার নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব মামলার ওপরের দিকে মন্ত্রী, এমপি ও প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার নাম রয়েছে। মাঝামাঝি পর্যায়ে ওই এলাকার মামলায় অধিকাংশ সময় স্থানীয় আওয়ামী কর্মী-সমর্থকদের নাম বেশি। তবে শেষ দিকে আসামি করা বেশিরভাগ মানুষ মামলায় বর্ণিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। এজাহারে তাদের কোনো রাজনৈতিক পদ নেই। মূলত, মামলা বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত শত্রুতির কারণে এসব আসামি করা হয়েছে।
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অনেক মামলার বাদী আসামিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আপোষনামা করছেন। ফলে জুলাই কেন্দ্রিক মামলা রমরমা বাণিজ্যের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তদন্তে দেখা গেছে, প্রকৃত ভুক্তভোগীরাও ভিত্তিহীন মামলায় জড়িয়েছেন। অন্যদিকে কিছু বাদী মিথ্যাভাবে নিজেদের আহত বা শোকাহত দেখিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা সুমন বলেন, ‘মামলায় আসামি অনেক থাকলেও পুলিশ সবাইকে গ্রেপ্তার করছে না। ভিডিও ফুটেজ দেখে যাচাই-বাছাই করে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ হয়রানিমূলকভাবে আসামি হন, নতুন আইন অনুযায়ী তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিলের আগে যেকোনো সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘থানা বা আদালতে মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। এ ধরনের ঢালাও মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে খতিয়ে দেখতে হবে উদ্দেশ্যমূলক আসামি করা হয়েছে কিনা। যদি অভিযোগ সত্য না হয়, নতুন আইন অনুযায়ী তদন্ত শেষ হওয়ার আগে যেকোনো সময় অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন