সমবায় সমিতিতে জমা টাকার ফেরত দাবিতে মাদারগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ঘেরাও
![]() |
| জামালপুরের মাদারগঞ্জে কয়েকটি সমিতি থেকে আমানতের টাকা উদ্ধারের দাবিতে উপজেলা পরিষদের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করছেন ভুক্তভোগীরা। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জামালপুরের মাদারগঞ্জে বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে রাখা আমানতের টাকা ফেরতের দাবিতে উপজেলা পরিষদ ঘেরাও করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা। তাঁদের অবস্থানের কারণে উপজেলা প্রশাসনের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে এ কর্মসূচি শুরু হয়। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, টাকা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের এই ঘেরাও কর্মসূচি বিরতিহীনভাবে চলবে।
এ বিষয়ে মাদারগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদির শাহ বলেন, ‘এই মুহূর্তে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ রয়েছে। এটা প্রায়ই হচ্ছে। সেবাগ্রহীতারা কোনো অফিসে প্রবেশ করতে পারছেন না। এতে সেবাগ্রহীতা এবং আমরাও ভোগান্তিতে পড়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
‘মাদারগঞ্জে বিভিন্ন সমবায় সমিতিতে আমানতকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য সহায়ক কমিটি’—এই ব্যানারে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও অংশ নেন।
প্রায় এক বছর ধরে এই ব্যানারে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ এবং একাধিকবার উপজেলা পরিষদ ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তবু কোনো গ্রাহকই এখনো টাকা ফেরত পাননি।
ভুক্তভোগীরা জানান, তাঁরা লাভের আশায় কষ্টার্জিত টাকা সমবায় সমিতি নামে ২৩টি প্রতিষ্ঠানে জমা করেছিলেন। কেউ এককালীন, কেউ মাসে মাসে টাকা জমা দিতেন এবং লাভের টাকা তুলতেন। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা, মূল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কায় আছেন তাঁরা।
আজ সকাল ১১টার পর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপজেলা পরিষদ চত্বরে জড়ো হন। পরে তাঁরা পরিষদের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে কার্যালয় ঘেরাও করেন। এতে উপজেলা পরিষদসহ সব দপ্তরের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় আন্দোলনকারীরা নানা স্লোগান দেন।
উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ১১টার দিকে ভুক্তভোগীরা প্রতিটি অফিসে ঢুকে কর্মকর্তাদের ও কর্মচারীদের বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেন। আন্দোলনকারীদের আহ্বানে সবাই বাইরে চলে যান। এরপর প্রতিটি অফিসের দরজার সামনে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন। ফলে কেউ আর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। বন্ধ হয়ে যায় সব দপ্তরের কাজ।
বক্তারা জানান, লাভের আশায় ২৩টি সমবায় সমিতিতে প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহক টাকা জমা করেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা ২০২২ সালের শেষের দিকে হঠাৎ আত্মগোপনে চলে যান। তাঁরা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়েছিলেন। এভাবে জামালপুর থেকে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ভুক্তভোগীদের এখন পথ বন্ধ। তিন বছর ধরে নানা কর্মসূচি পালন করেও কোনো ফল মেলেনি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মালিকেরা আত্মগোপনে যাওয়ার পর তাঁরা মাদারগঞ্জ থানা ও জামালপুর আদালতে একাধিক মামলা করেছেন। জেলা প্রশাসক, জেলা সমবায় কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দিয়েছেন। কিন্তু আমানতের টাকা উদ্ধারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
হঠাৎ করে আন্দোলনকারীরা উপজেলা পরিষদের সব কার্যালয়ের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে জানিয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, এখানে আমাদের কিছু করার নেই। গত এক বছরে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে তাঁদের টাকা ফেরত দিতে, কিন্তু কোথায় যেন গিয়ে সব আটকে যায়। কিছুতেই কিছু হয় না। এটার কোনো সমাধান আমাদের হাতে নেই। সমিতিগুলোর বেশির ভাগই নিবন্ধিত। আমরা চাইলে শুধু নিবন্ধন বাতিল করতে পারি। কিন্তু তা করলে গ্রাহকেরা আরও বিপদে পড়বেন। তাই সেটাও করা যাচ্ছে না। জামালপুরের প্রশাসন সব দিক থেকে চেষ্টা করেছে, তবু কোনো ফল মিলছে না।’
জেলা সমবায় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাহকদের প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা এসব সমবায় সমিতিতে ছিল। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা দাবি করছেন, ২৩টি সমিতির মধ্যে আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, নবদীপ, হলিটার্গেট ও রংধনু সবচেয়ে বড়। শুধু এই ছয়টি সমিতির কাছেই রয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। মাদারগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্তদের হিসাবে দেখা গেছে, প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। এ ছাড়া ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ী ও জামালপুর সদরেও কয়েক হাজার গ্রাহক রয়েছেন।
আমানতের অর্থ উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক শিবলুল বারী বলেন, কয়েক বছর ধরেই এই আন্দোলন চলছে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, প্রশাসন সমিতিগুলোর মালিকদের পক্ষেই কাজ করছে। না হলে এত দিনেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? মালিকপক্ষ ও তাঁদের দালালদের সঙ্গে গোপনে সভা করছেন প্রশাসনের কেউ কেউ—এমন অভিযোগও রয়েছে। যেসব সমবায় প্রতিষ্ঠান এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কাউকে গ্রেপ্তার করছে না। ফলে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে গ্রাহকদের মনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন