[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক নিয়োগ বাতিল: হুমকির কাছে নতি স্বীকার

প্রকাশঃ
অ+ অ-
সামিনা লুৎফা | গ্রাফিকস: পদ্মা ট্রিবিউন 

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক পদ বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়েছে, এটা খুবই ভয়ংকর একটা আশঙ্কার জায়গা তৈরি করেছে নাগরিকদের মধ্যে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গোষ্ঠীর চাপে তাদের সিদ্ধান্ত বদল এই প্রথমবার করেনি, এর আগেও করেছে।

আমরা এর আগে পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের কমিটি বাতিল হতে দেখেছি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে ঐকমত্যের আলোচনাতেই আনা হয়নি। এখানেও নানা গোষ্ঠীর চাপ কাজ করেছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মাত্র ২ হাজার ৫০০ জন শরীরচর্চার শিক্ষক সব বিদ্যালয়ের জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় তারা এ সিদ্ধান্ত সচিব কমিটির সুপারিশে বাতিল করেছে। নাগরিক হিসেবে আমি বুঝেছি যে ‘গোষ্ঠীর চাপে নয় বরং টাকার অভাবে এত ভালো পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো’—এটা দেখানোই উদ্দেশ্য। কিন্তু এটা প্রকৃত কারণ নয়। না হলে বিষয়টা এত দূর গড়াতই না।

সরকারের বিজ্ঞপ্তি প্রধান উপদেষ্টার যে ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া হয়েছে, সেখানকার মন্তব্য পড়লেই বোঝা যায় যে কাদের খুশি করতে এই পিছিয়ে যাওয়া।

প্রথমত, সচিব কমিটি শুরুতে তাদের পরামর্শ নিয়ে কোথায় ছিল?

দ্বিতীয়ত, ক্লাস্টারভিত্তিক পরীক্ষামূলক এবং ঐচ্ছিক হিসেবে শুরু করে পরে ধাপে ধাপে সংখ্যাটি বাড়ানো যেত। সেটা ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করত বলে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটাই বরং কার্তিক মাসে আষাঢ়ে যুক্তি বলে মনে হচ্ছে।

তৃতীয়ত, যুদ্ধবিমান কেনা বা সবাইকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক বিষয়ে ব্যয় করার মতো অর্থ পাওয়া যায়। কিন্তু শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য অর্থ না থাকার যুক্তি দেওয়াও সরকারের দেউলিয়াত্বই প্রকাশ করে।

এটা আমাদের জন্য আসলে অসম্ভব দুঃখজনক যে সরকার একটা গোষ্ঠীর চাপে নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার এবং শিশুদের মানসিক বিকাশের অধিকার খর্ব করল। শিশুদের জন্য সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিবাচক, যা আশা জাগিয়েছিল। অথচ তা বাতিল করা হলো। পৃথিবীব্যাপী, এমনকি ইসলামি দেশগুলোরও অনেকগুলোতে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

শিশুদের সৃজনশীল সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সংগীতের ভূমিকা অপরিসীম। ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, সংগীত শিশুর মানসিক বিকাশ ও সামাজিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয়। সংস্কৃতি আসলে বহমান নদীর মতো। এটা কোথাও আটকা পড়ে গেলে বড়ই মুশকিলের হয়ে যায়। ইউনেসকো বা জাতিসংঘের অন্যান্য ফ্রেমওয়ার্ক, এডুকেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক, শিশুদের অধিকার সনদ—সবকিছুর বিচারেই এ সিদ্ধান্ত বাতিল হওয়া আশঙ্কার।

শিশুদের মানবিক বিকাশ, সামাজিকীকরণ, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো—সব ক্ষেত্রেই এর ভূমিকা আছে। শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ীও তাদের নাচ-গান, খেলাধুলাসহ সব ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম থাকার কথা। তা না হলে তো আসলে শিশুর অধিকার ও মানবাধিকার খর্ব হয় এবং যথার্থ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর দলগত কাজের অভিজ্ঞতা হয়, আত্মবিশ্বাস এবং যূথতার বোধ তৈরি হয়। তাই খেলাধুলা ও শারীরিক চর্চা শিশুদের গড়ে ওঠার সময় তাদের মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সংগীতের যে আবেদন, সেটা তো বৈশ্বিক এবং এটা সর্বজনীন। সুর ও সংগীত মানুষকে সব সময় বিনয়ী ও মানবিক করতে সাহায্য করে এবং তার মানসিক বিকাশে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান। সবকিছুকে বস্তুবাচক লেনদেনের মধ্যে রাখা যায় না।

শিশুদের বিকাশের জন্য সারা বিশ্বের মানুষই নানা সৃজনশীল পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং তার মধ্যে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীতের ব্যবহার সহপাঠের প্রচলিত অংশ। এটা বন্ধ করার চেষ্টা একধরনের ফ্যাসিবাদী হুমকি। সেই হুমকির কাছে নতি স্বীকার করে সরকার আসলে সবাইকে একটা বার্তা দিচ্ছে যে কেউ এ রকম ধর্মের অপব্যবহার করে যেকোনো কিছু সরকারকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে। এটা খুবই ভীতিপ্রদ।

এত বড় লড়াই করে একটা ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটিয়ে আমরা যদি একধরনের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের দিকে যাই, সেটা আমাদের এত বছরের লড়াই বা মানবাধিকার কিংবা শিশুদের অধিকারের জায়গা থেকে—সব দিক থেকেই অত্যন্ত বড় হুমকি। এটা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি, দেশের নাগরিকদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। তাই আমি সরকারকে অনুরোধ করব, শিশুদের ‘হ্যাঁ’ বলুন। যারা সংগীত বা শারীরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়, সেসব শিশুর জন্য এ বিষয় বাধ্যতামূলক না করে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রেখে এই ২ হাজার ৫০০ ক্লাস্টারে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিন, দেশ বদলে যাবে।

● লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব  

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন