[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

সেন্টমার্টিনে কর্মসংস্থান সংকটে চাপে মানুষ

প্রকাশঃ
অ+ অ-
সেন্টমার্টিন দ্বীপ | ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দারিদ্র্য খুব বেশি। নতুন প্রস্তাবিত পরিকল্পনার খসড়া অনুযায়ী, দ্বীপের ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। শিক্ষার সুযোগ সীমিত থাকার কারণে ৬৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৭৮ শতাংশ নারী অক্ষর। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে শৌচাগার নেই। এছাড়া, কর্মসংস্থানের অভাবে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।

পরিকল্পনার খসড়ায় দ্বীপের আর্থ-সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেন্টমার্টিনে ১ হাজার ৪৪৫টি পরিবার বসবাস করছে, যেখানে মোট জনসংখ্যা ৯ হাজার ৮৮৫ জন। প্রতি পরিবারের গড় সদস্য সংখ্যা ৬.৮৪ জন, যা দেশের গড়ের চেয়ে বেশি। জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ—৪২ শতাংশ ১৮ বছরের নিচে এবং প্রায় ৪৪ শতাংশ ১৯ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলে এই জনমিতিক কাঠামো দ্বীপের জন্য সুবিধা দিতে পারে।

দ্বীপের অর্থনীতি মূলত মৎস্য আহরণ ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। মোট আয়ের ৬১ শতাংশ আসে মাছ ধরার মাধ্যমে, আর ৩১ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। স্থানীয় পরিবারের গড় মাসিক আয় মাত্র ৬ হাজার ৪৪৮ টাকা, যা দেশের গড়ের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া, মাছ ধরার ও পর্যটনভিত্তিক কাজগুলো মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় স্থায়ী আয় নিশ্চিত করা কঠিন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ড. ফাহমিদা খানম বলেন, 'সেন্টমার্টিনে বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য আছে, এগুলো রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আয় করলেও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করলে পরিবেশও বাঁচবে, আয়ও হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'শুধু পর্যটক বাড়ানো যথেষ্ট নয়। জীববৈচিত্র্য না থাকলে আয়ও হবে না। উন্নয়ন অবশ্যই হবে, কিন্তু দ্বীপবাসীদের আয়ের বিষয়টিও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। তাই প্রকল্পগুলো সেই অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে।'

সেন্টমার্টিনে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। দ্বীপে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়-কলেজ, একটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৭টি মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি হলেও জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষার হার কম।

দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ প্রধানত টেকনাফ থেকে ফেরি পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষা ও মৌসুমি দুর্যোগে যোগাযোগ অনিশ্চিত হয়। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ পায়ে হেঁটে, রিকশাভ্যান ও ভাড়া সাইকেলের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে যাওয়া কঠিন।

সেন্টমার্টিনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হয় না। শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিপূর্ণভাবে মূল ভূখণ্ডে যেতে হয়। এতে শিক্ষার ধারাবাহিকতা ভেঙে যায় এবং বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হয়।

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। দ্বীপে একটি হাসপাতাল থাকলেও জনবল ও সেবার মান সীমিত। অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ফার্মেসি এবং জটিল সমস্যার জন্য দূরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এতে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

বাসস্থানের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। ৬৮ শতাংশ মানুষ কাঁচা ঘরে, ১৭.৪ শতাংশ ঝুপড়ি, ১৩.৭ শতাংশ সেমি-পাকা ঘরে এবং মাত্র ০.৯ শতাংশ পাকা ঘরে থাকে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ডিজেল জেনারেটর থেকে সৌর গ্রিডে পরিবর্তন হলেও খরচ বেশি।

স্যানিট্রেশনও বড় চ্যালেঞ্জ। ৩০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফ্লাশ টয়লেট ব্যবহার করে, ১৮ শতাংশ পিট ল্যাট্রিন, ১১ শতাংশ ওয়াটার শিল্ড ট্যাংক, আর ৩৫ শতাংশ মানুষের কোনও স্যানিট্রেশন সুবিধা নেই। কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই।

দ্বীপে পর্যটন দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে হোটেল ও রিসোর্ট সংখ্যা ১৯০টির বেশি, তবে অর্ধেক মালিক বাহ্যিক। ফলে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক সুযোগ সীমিত। স্থানীয়রা পর্যটন ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমি কর্মসংস্থান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।

পরিকল্পনার খসড়ায় বিকল্প আয়ের জন্য ক্ষুদ্রঋণ সেবা ও অংশগ্রহণমূলক ইকোসিস্টেম ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে। এতে ন্যায্যতাভিত্তিক সুবিধা ভাগাভাগি, সীমিত মাত্রায় মাছ আহরণ এবং বাফার জোনের মাধ্যমে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা হবে।

আগামী জানুয়ারি থেকে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবে। তবে পরিকল্পনার খসড়ায় প্রতিদিন ৫০০–৯০০ জন পর্যটক রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পিক সিজনে প্রতিদিন ৩ থেকে ৭ হাজার পর্যটক দ্বীপে আসে। রাত্রিযাপন সুবিধা আছে ৪,১৫৫ জনের জন্য, কিন্তু দ্বিগুণ পর্যটক আসে। ১০৯টি প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের আবাসন দেয়।

অনিয়ন্ত্রিত রিসোর্ট সম্প্রসারণের কারণে আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত। এতে পর্যটন সুবিধার মান ও স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের সংরক্ষণ ও পর্যটন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে— অবকাঠামো নির্মাণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের ক্ষতি করে নতুন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা, দ্বীপের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাধ্যতামূলক অনলাইন নিবন্ধন ও প্রবেশ ফি, বর্জ্য ফেলা, শব্দদূষণ ও সামুদ্রিক জীব সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা, দ্বীপে মোটরচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ, নির্দিষ্ট রাস্তায় রিকশা ও বাইসাইকেল চলবে, সামুদ্রিক আবাস-চরিত্র রক্ষার জন্য পর্যটকবাহী হাজাজের গতি নিয়ন্ত্রণ ও নির্দিষ্ট দূরত্বে নোঙর।

সরকার সেন্টমার্টিনের চারপাশে ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে, যা মোট অঞ্চলের প্রায় ১.৫ শতাংশ। এতে ২০২৩টি বেশি প্রজাতির মাছ এবং হুমকির মুখে থাকা সামুদ্রিক প্রাণী যেমন ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্পাক ডলফিন, হোয়েল শার্ক ও বিভিন্ন কচ্ছপ সুরক্ষিত।

২০২৩ সালের পরিবেশবান্ধব পর্যটন নির্দেশিকার পরিবর্তে পরিকল্পনার খসড়ায় আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ও প্রয়োগযোগ্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

পরিকল্পনার খসড়ায়, সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এখানে ম্যানগ্রোভ বন, প্রবাল প্রাচীর এবং শৈবালের মতো বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য রয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান পর্যটন ও জনসংক্যার কারণে পরিবেশ চাপে। পরিবেশ অধিদফতর দ্বীপের ‘পরিবেশভিত্তিক উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে।

দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনায় ৯টি খাতে ২৬টি লক্ষ্যভিত্তিক প্রকল্প রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা ৪টি প্রকল্প, মৎস সম্পদ ও বেনথিক জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ২টি প্রকল্প, প্রবাল সম্পদ ও প্রবাল-নির্ভর উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ ২টি প্রকল্প, কচ্ছপ বসবাস ও ডিম পাড়ার স্থান সংরক্ষণ ২টি প্রকল্প, স্থলভিত্তিক উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ ৬টি প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ২টি প্রকল্প, ভূগর্ভস্থ জলের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ২টি প্রকল্প, অভ্যন্তরীণ সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন ২টি প্রকল্প ও জীবন-জীবিকা উন্নয়ন ৩টি প্রকল্প।

মোট ব্যয় আনুমানিক ৫৪৭.৯ মিলিয়ন টাকা। পরিকল্পনায় স্বল্প (১–৩ বছর), মধ্য (১–৫ বছর) ও দীর্ঘ মেয়াদি (১–১০ বছর) কাজ ভাগ করা হয়েছে।

সেন্টমার্টিন বঙ্গোপসাগরের কাছে অবস্থিত, স্থানীয়ভাবে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে পরিচিত। দ্বীপটি টেকনাফ পেনিনসুলার দক্ষিণে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে এবং মিয়ানমার উপকূলের কাছাকাছি। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার অংশ। সামুদ্রিক সীমানার কৌশলগত অবস্থানের কারণে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা জেলা প্রশাসন ও জাতীয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে।

দ্বীপের প্রবাল প্রাচীর নানা চ্যালেঞ্জের মুখে—অতিরিক্ত পর্যটক চলাচল, স্যুভেনির ব্যবসা, অতিরিক্ত প্রবাল উত্তোলন, বর্জ্য ও রাসায়নিক দূষণ, বিদেশি ট্রলার, জমাট পলি, পরিত্যক্ত জাল, নৌকা নোঙর, ভাঙন এবং অবৈধ প্রবাল সংগ্রহ। প্রবাল ব্লিচিং ও রোগ প্রবালের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে ফেলে। তাই কার্যকর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কৌশল জরুরি।

দ্বীপে প্রধান পানীয় উৎস ৭২৭টি অগভীর নলকূপ। তবে সব জায়গায় পানি সমান মানের নয়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে শৌচাগারের অভাব, কেন্দ্রীয় পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ মূলত সৌরশক্তি নির্ভর; প্রায় ৪৫ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্ন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় সম্প্রসারণ সীমিত।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন