দ্বীপের বেওয়ারিশ কুকুরদের প্রজনন বন্ধ করার উদ্যোগ
| সেন্টমার্টিনের বেওয়ারিশ কুকুরের যত্ন নিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা | ফাইল ফটো |
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপটি জীববৈচিত্র্যের সমাহারে ভরপুর। এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। তবে দ্বীপে প্রায় সাত হাজার বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য প্রায়ই আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কুকুরদের আক্রমণে সৈকতে ডিম দিতে আসা মা কচ্ছপও মারা যায়।
সম্প্রতি সরকারের উদ্যোগে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও দ্বীপের বেওয়ারিশ কুকুরকে বন্ধ্যা করা, স্থানান্তর বা নিধনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আইনগত ও নৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিনকে রক্ষার জন্য খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এতে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই খসড়া সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২৪ নভেম্বর এটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবপোর্টালে উন্মুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে লিখিত মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে সব মাদি কুকুরের বন্ধ্যা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বীপের সব কুকুরের বন্ধ্যা করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ড. ফাহমিদা খানম জানিয়েছেন, 'সেন্টমার্টিনে অনেক বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। এটি রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খসড়া মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মতামত দিতে পারেন। মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত পরিকল্পনা হবে।'
খসড়া সমন্বিত পরিকল্পনা জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ২৬টি প্রকল্পের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ৫৪৭.৯ বিলিয়ন টাকা।
কুকুর বন্ধ্যা কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, দ্বীপে ৩ হাজার ৩০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ ফেরারি কুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ কুকুরের প্রজনন ক্ষমতা ইতিমধ্যেই বন্ধ করা হয়েছে।
পরিকল্পনায় কুকুরজনিত সমস্যাও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কুকুর কামড়ানোর কারণে স্থানীয় ও পর্যটকরা ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। এতে রেবিসসহ নানা রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আতঙ্কের কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় অস্বস্তি অনুভব করেন।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতির বিষয়েও বলা হয়েছে, কুকুর কচ্ছপের ডিম ও বাচ্চাদের আক্রমণ করে। এতে দ্বীপের প্রাকৃতিক বন্যপ্রাণী ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
প্রাণী কল্যাণের দিকেও সংকট রয়েছে। পর্যটন মৌসুমে কুকুর খাবারের জন্য নির্ভর করে হোটেল-রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া খাবারের ওপর। মৌসুম না থাকলে খাবারের অভাবে কুকুর ক্ষুধায় কষ্ট পায়। অনেক কুকুর অসুস্থ, আহত ও অপুষ্টিতে ভুগছে।
পর্যটন ও সামাজিক প্রভাবেও কুকুরের উপস্থিতি নেতিবাচক। পর্যটকরা আতঙ্কিত হয়ে দ্বীপে বেড়াতে ভয় পান। স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবনও ব্যাহত হয়।
পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক ব্যারিস্টার রাবাব চৌধুরী বলেন, 'যদি কুকুর বন্ধ্যা করা হয়, তবে দ্বীপে কুকুর বিলুপ্ত হবে না। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, তবে বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বন্ধ্যা করা মারামারি কমায় এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমায়। এটি ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ কমাতে সাহায্য করে।'
পরিকল্পনায় কুকুর নির্বীজকরণ, টিকাদান, গণনা ও জরিপসহ বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। ইতিমধ্যেই ১ হাজাত ৯১৭টি কুকুরকে টিকা দেওয়া হয়েছে। কিছু কুকুরকে বন্ধ্যা করা হয়েছে। খাওয়ানো নিয়ন্ত্রণ, নতুন পোষা প্রাণী আনা বন্ধ, পোষা কুকুরের নির্বীজকরণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ কুকুর নির্বীজকরণ, ২০২৬ সালে সব মাদি কুকুর নির্বীজকরণ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন হবে।
কুকুর বন্ধ্যা কর্মসূচি চ্যালেঞ্জপূর্ণ। এখনও নির্বীজকরণের হার কম। পর্যাপ্ত তহবিল ও জনবল নেই। খাদ্যের টেকসই ব্যবস্থা নেই। স্থানান্তর বা কুকুর নিধনের আইনগত ও নৈতিক বিতর্ক রয়েছে। স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের আচরণ পরিবর্তন করা কঠিন।
দ্বীপের প্রাণীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে ১৯৪ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৫৯ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং মিঠাপানির কচ্ছপ আছে। গবেষণা চলাকালীন আরও প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
দ্বীপে মাছের প্রজাতি ৪৭৫। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ৯টি একাইনোডার্ম এবং ১৮৭টি মোলাস্ক প্রজাতি রয়েছে। ক্রাইটোসিয়ানদের মধ্যে ১২ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ২৬ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া গেছে।
Comments
Comments