ময়মনসিংহের সরকারি লাইনে ময়লা পানি, পোকা-শামুকের ভিড়
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের যাত্রা শুরু হয়েছে সাত বছর আগে। তবু এখনো সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত নাগরিকেরা। প্রায় দেড় লাখ নিম্নআয়ের মানুষের চাহিদা থাকলেও পানির সংযোগ আছে মাত্র সাত হাজার পরিবারের। বিকল্প উপায়ে বাসিন্দারা সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে পানি তুলছেন, এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ বলেন, ‘পৌরসভা থাকার সময় যে সব পানির গ্রাহক ছিলেন, এখনো তাঁরাই আছেন। পানির সংযোগ ও পাম্পহাউসগুলো পৌরসভার সময়ের পুরোনো। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর জনগণ বেড়েছে, কিন্তু পানি সরবরাহের সক্ষমতা বাড়েনি। আমাদের রাজস্ব আয় খুব সামান্য, সরকার থেকে বিশেষ প্রকল্প না এলে বড় কোনো প্রকল্প নেওয়ার সক্ষমতা নেই।’
নগরের বাসিন্দাদের প্রতি মাসে পানি সংযোগের জন্য ১৫০ টাকা বিল দিতে হয়। এর সঙ্গে হোল্ডিং ট্যাক্সে যোগ হয় পানির রেট খাতে মোট বিলের ৩ শতাংশ চার্জ। তবু সরকারি লাইনে আসে দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত পানি। এই পানি ব্যবহারে শরীরে চুলকানিসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
ময়মনসিংহ নগরের বাঁশবাড়ি কলোনিতে প্রায় তিন হাজার নিম্নআয়ের পরিবারের বসবাস। সেখানে আছে সিটি করপোরেশনের পানির সংযোগ। প্রতিদিন সকাল ৭টা, দুপুর ১২টা ও বিকেল ৪টায় লাইনে পানি আসে। পানি পেতে বাসিন্দারা আগেভাগেই বালতি-বোল পেতে রাখেন। ময়লা পানি আসায় পাইপ ও কলের মুখে কাপড় বা টিস্যু ব্যাগ বেঁধে রাখেন, যাতে কিছুটা ছেঁকে নেওয়া যায়।
ময়না বেগম নামের এক বাসিন্দা বলেন, পানিতে পোকা ও শামুক পর্যন্ত আসে। এ থেকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হয়। এই পানি ব্যবহার করলে শরীরে চুলকানি হয়।
আম্বিয়া খাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেড় শ টাকা বিল দিই, আবার পচা পানি পাই—এইডা আমরা চাই না। আমরা ভালা পানি চাই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ‘বর্তমানে সিটি করপোরেশন বিষয়টিকে একেবারে অবহেলা করছে। দূষিত পানি ঘরে ঘরে যাচ্ছে। আমরা চাই, প্রতিটি ওয়ার্ডে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হোক।’
![]() |
| তুলনামূলক পরিষ্কার পানি পেতে পাইপের মুখে কাপড় বাঁধছেন এক নারী। সম্প্রতি নগরের বাঁশবাড়ি কলোনিতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ডের আংশিক এলাকায় বর্তমানে ৭ হাজার ৫৫৬টি পানির সংযোগ আছে। দুই বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৮ হাজার। সিটি করপোরেশনের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পানি শাখার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে দেখা গেছে, আয়ের চেয়ে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা আয় হলেও ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৯৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অন্য খাত থেকে ভর্তুকি দিয়ে পানি শাখা চালানো হচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি করপোরেশনের পানি শাখার জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. মামুন-অর-রশিদ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের ১৮৭ কিলোমিটার পানির লাইন রক্ষণাবেক্ষণ করেই কূল পাওয়া যায় না। নগরের ৮-১০টি বস্তি এলাকায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের মধ্যে সাপ্লাই পানির চাহিদা আছে। কিন্তু সক্ষমতার অভাবে পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। যেসব এলাকায় পানি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর লাইনও অনেক পুরোনো। তাই নতুন লাইন স্থাপন ছাড়া ভালো মানের পানি দেওয়া সম্ভব নয়।’
১৮৮৯ সালে মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী নগরের গোলপুকুর পাড় এলাকায় প্রথমবার যান্ত্রিকভাবে ব্রহ্মপুত্রের পানি শোধন করে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৩৬ বছর আগে শহরে সুপেয় পানি সরবরাহ শুরু হলেও বর্তমানে সিটি করপোরেশনে সেই ব্যবস্থা নেই।
সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, অনুমোদন নিয়ে নগর এলাকায় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে, যা মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, প্রকৃতপক্ষে সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।
এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক দীন ইসলাম। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার ও সাবমার্সিবল পাম্প বসালে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে এবং নানা সংকট তৈরি হবে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং অনুমতি ছাড়া কাউকে পাম্প বসাতে দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে নদীর পানি ব্যবহার করা যেতে পারে, তা শোধন করে সরবরাহ করা সম্ভব।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ জানিয়েছেন, নগরবাসীকে সাবমার্সিবল স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং যারা একাধিক পাম্প বসিয়েছেন, সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন