চাকসু নির্বাচনে বড় প্রতিশ্রুতি, শিক্ষার্থীদের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন
![]() |
গানে গানে ভোট চাচ্ছেন এক প্রার্থী। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আসন্ন চাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্যানেল শিক্ষার্থীদের জন্য বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেউ ভোটে জিতলে বহুতল হল নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন, কেউ শাটল ট্রেনে এসি বগি চালুর ও শহর পর্যন্ত বাস চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এক বছরের মধ্যে এসব কতটা বাস্তবায়নযোগ্য তা প্রশ্নের মতো। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলা ১০ শিক্ষার্থী মনে করেন, এক বছরের মধ্যে বহুতল হল নির্মাণ বা হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো প্রার্থীদের ইশতেহারে থাকা কল্পনার সীমার মধ্যে পড়ে। কারণ, এসব অবকাঠামো নির্মাণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব, সরকারের অর্থ বরাদ্দ এবং নানা ধাপ অতিক্রম করার প্রয়োজন। ফলে এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তবে প্রার্থীরা যুক্তি দিচ্ছেন, চাপ সৃষ্টি করে প্রশাসনকে দাবি আদায়ে বাধ্য করবেন।
লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিয়াম আল জাকি বলেন, 'এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, যা ইশতেহারগুলোতে রাখা হয়নি। মনে হচ্ছে এক বছরেই সব সমস্যার সমাধান করবে চাকসু।'
১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে লড়ছে ১৩টি প্যানেল। এখন পর্যন্ত ৯টি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে, যেগুলোতে মোট ১৭০টি দফা রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিস-সমর্থিত ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ এবং ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামের দুই প্যানেল ইশতেহার প্রকাশ করেছে।
দুই ইশতেহারেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও একাডেমিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ৯টি প্যানেলের ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট প্রায় সবই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবকাঠামো ছাড়াও গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়া, ক্যাম্পাসে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি সহ নানা দফা উল্লেখ করা হয়েছে।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মহিম ইফতি বলেন, 'দফাগুলো শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন অসম্ভব।'
চাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে, সহযোগিতা দিতে, সামাজিক সংযোগ বাড়াতে এবং সহপাঠ্যক্রমের বাইরে কার্যক্রমের সুযোগ দিতে সাহায্য করে। চাকসু শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণ বাড়াতে সহায়ক এবং ক্যাম্পাসের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
গঠনতন্ত্রে চাকসুর ৯টি কাজ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে—শিক্ষার্থীদের অধিকার, চাহিদা ও সমস্যাগুলো প্রশাসন এবং শিক্ষকদের কাছে তুলে ধরা; গবেষণা, পরিবেশ, উদ্ভাবন, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ও আবাসন বিষয়ক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া; এবং সামাজিক সম্মেলন, নাটক, সংগীতানুষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে আবাসনসংকট আছে। নতুন হল দরকার। শাটল ট্রেনের বগি বাড়ানো দরকার। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করা আছে, চাকসু নির্বাচিত হলে প্রশাসনকে নিয়মিত চাপ দিয়ে দাবি আদায় করবে। নতুন ভবন নির্মাণ বা হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো চাকসুর কাজ নয়। ফলে শুধু বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়।
শুরুতেই ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ইশতেহারের দিকে নজর দেওয়া যাক। তাদের ইশতেহারে ৯টি মূল বিষয় ও ৩৩টি দফা রাখা হয়েছে। প্রার্থীরা মনে করেন, নির্বাচিত হলে ১২ মাসের মধ্যে এসব দফা বাস্তবায়ন করতে পারবে।
এই প্যানেলের ইশতেহারের প্রথম দফা আবাসনসংকট সমাধানকে কেন্দ্র করে। বলা হয়েছে, নির্বাচিত হলে বিদ্যমান হলগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও এক্সটেনশন ব্লক বাড়ানো হবে এবং নতুন টিনশেড ঘর নির্মাণের মাধ্যমে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসন বাড়ানো হবে। স্থায়ী সমাধান হিসেবে শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল হল নির্মাণ করা হবে। তবে ছাত্রশিবিরের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহিম হোসেন প্রথম আলকে বলেন, এক বছরের মধ্যে সব দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু কিছু টিনশেড ঘর নির্মাণ করে আবাসনসংকট নিরসন করা সম্ভব।
অন্যদিকে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহারে ৮টি দফা রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্বাচিত হলে শাটল ট্রেনে এসি বগি সংযোজনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শাটল ট্রেনের দ্বিমুখী চলাচলের জন্য ডাবল লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রটি ১০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এই ৮টি দফা বাস্তবসম্মত এবং এগুলো এক বছরের মধ্যে হয়তো সব বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তবে নির্বাচিত হলে এগুলো ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন-সমর্থিত বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্যের ইশতেহারে ৭টি দফা রাখা হয়েছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠকে স্টেডিয়ামে রূপান্তর এবং অলিম্পিক মানের সুইমিংপুল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি নতুন হল নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. বখতেয়ার উদ্দিন বলেন, ভবন নির্মাণ বা শাটল ট্রেন চালানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্ব। তবে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে দাবি জানাতে পারে এবং চাপ দিয়ে তা আদায় করতে পারে। এসব অবকাঠামো তৈরি করা চাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ নয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন