নারী নির্যাতনবিরোধী বার্তায় রাজশাহীর পূজা মণ্ডপ
![]() |
রাজশাহী শহরের মালোপাড়ার লক্ষ্মী নারায়ণ দেব বিগ্রহ ঠাকুর মন্দির যেন এবারের দুর্গাপূজায় নারী নির্যাতনবিরোধী চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সোমবার রাতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহীর মালোপাড়ার শ্রীশ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ দেব বিগ্রহ ঠাকুর মন্দিরের পূজা মণ্ডপে এবার ভিন্ন এক আয়োজন। প্রতিমার আগে চোখে পড়ছে নির্যাতিত এক নারীর ছবি। তাঁকে পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা, আঁচল ছড়িয়ে আছে সিঁড়িতে। এক পাশে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য, অন্য পাশে ইভ টিজিং আর শিশু ধর্ষণের শিকার আতঙ্কিত নারীমুখ।
প্রতিমার নিচের অংশে বাম পাশে রাখা হয়েছে ভ্রূণহত্যা নিয়ে কন্যাশিশুর আবেগভরা কিছু লেখা। ডান পাশে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা যন্ত্রণাকাতর এক মায়ের প্রতিচ্ছবি। সব মিলিয়ে মণ্ডপটি নারীর অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার বার্তা দিচ্ছে।
সোমবার সন্ধ্যায় দেখা যায়, নির্যাতিত নারীর ছবির পাশে লেখা—‘সুনিশ্চিত হোক নারীর নিরাপত্তা, থেমে না যাক তাদের স্বপ্নযাত্রা।’ আরেক পাশে লেখা—‘গ্রাম থেকে শহর—প্রতিটি পথে, নিরাপদ চলুক নারী দিন-রাতে।’
প্যান্ডেলে বিভিন্ন শিরোনামে সাজানো হয়েছে নারীর জীবনচক্রের অধ্যায়। কন্যাভ্রূণের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে লেখা হয়েছে,
‘আসতে দাও পৃথিবীতে, করছ কেন খুন?
আমার দোষ কি শুধু আমি কন্যাভ্রূণ?
আমার থেকেই নতুন জীবন, সৃষ্টি মানে আমি।
আমি যদি খুন হয়ে যাই, কীভাবে আসবে তুমি?’
ইভ টিজিং, চার দেয়ালে বন্দী নারী, সমাজের কুকথায় কষ্ট পাওয়া মেয়েদের ছবি আর পাশে লেখা—‘লালসায় উত্তপ্ত চোখ, শিশু ধর্ষণ বন্ধ হোক।’
অন্য এক লেখায় আছে—‘বেরোতে পারি না একা, এ সমাজ নষ্ট মানুষের মুখোশে ঢাকা।’
আত্মবিশ্বাসী নারীর আহ্বানও রাখা হয়েছে—
‘ফিনফিনে কাপড়ের ভাঁজে খুঁজে ফেরো নারী।
কখনো মানুষ ভেবে সুযোগ দিয়ো! দেখবে, আমরাও পারি।’
শেষ অংশে তুলে ধরা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়ের একাকিত্ব—
‘দশ মাস দশ দিন যন্ত্রণার ফল কি আজ বৃদ্ধাশ্রম!’
‘মা সেদিনও কেঁদেছিল, ছেলে ভাত খায় না বলে,
আর আজ কাঁদে, ছেলে ভাত দেয় না বলে।’
‘এক মাকে পুজো করো, আরেক মাকে ঘর থেকে বের করো?’
এ অংশে নচিকেতার গানের লাইনও লেখা হয়েছে—‘ছেলে আমার মস্ত বড়, মস্ত অফিসার...।’
প্রতিমায় লক্ষ্মী ও সরস্বতীর শান্ত রূপের পাশাপাশি আছে চণ্ডীর শক্তি। মণ্ডপে পৌরাণিক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্যও রাখা হয়েছে, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ ও দেবীশক্তির প্রতীক।
মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুনন্দন দাস বলেন, 'আমরা চাই, পূজার আনন্দের পাশাপাশি মানুষ নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়েও ভাবুক।'
সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী পাপন চন্দ্র রায় বলেন, 'দুর্গোৎসব কেবল উৎসব নয়, এটি হতে পারে সচেতনতার মঞ্চ। তাই আমাদের সামান্য বাজেটেও এই থিম করেছি।'
কোষাধ্যক্ষ রতন পাল বলেন, 'আমরা আশা করি, এই থিম সমাজে নারীর মর্যাদা নিয়ে ভাবতে মানুষকে উৎসাহিত করবে।'
দর্শনার্থীরা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ছবিগুলোর পাশে লেখা বার্তাগুলো মন দিয়ে পড়ছিলেন। বিভা সাহা নামের এক দর্শনার্থী বলেন, 'আয়োজন সাদামাটা হলেও বার্তাটি বড়। উৎসব শুধু আনন্দ নয়, সচেতনতার মঞ্চও হতে পারে—এ আয়োজন তা দেখিয়েছে।'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন