২১ বছরে সবচেয়ে কম পাস, শিক্ষায় গলদ নাকি অন্য কারণ?
![]() |
এক শিক্ষার্থী তাঁর ফলাফল অভিভাবককে জানাচ্ছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা, ১৬ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দুই দশকের মধ্যে এবার উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় সবচেয়ে কম পাসের হার রেকর্ড হয়েছে। ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯.১৬ শতাংশ। এর পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। কিন্তু এবার তা একপ্রকার বড় ধাক্কা খেয়েছে। ২১ বছর পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলে একপ্রকার ধস নেমেছে।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার হয়েছে ৫৭.১২ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ এ বছর প্রায় ৪৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি।
![]() |
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা ফল পেয়ে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। বেইলি রোড, ঢাকা, ১৬ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শুধু পাসের হারই কমেনি, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিপুলভাবে কমেছে। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, তার আগের বছর ৭৮ হাজার ৫২১ জন; কিন্তু এ বছর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।
আজ বৃহস্পতিবার এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এ বছর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৬ জন। একই সঙ্গে মাদ্রাসার আলিম এবং কারিগরির এইচএসসি ভোকেশনাল, বিএম ও ডিপ্লোমা ইন কর্মাস পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ করা হয়েছে।
![]() |
সন্তানের ফলাফল মুঠোফোনে দেখছেন বাবা, সঙ্গে মেয়ে। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা, ১৬ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দেশের শিক্ষার তথ্য নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) বলছে, ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশের বেশি। ২০০৬ সালে তা বেড়ে প্রায় ৬৪ শতাংশে পৌঁছায়। ২০০৭ সালে ৬৪ শতাংশের ওপরে থাকে, আর ২০০৮ সালে প্রায় ৭৫ শতাংশ হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে কমে গিয়ে ৭০.৪৩ শতাংশে নেমে আসে।
এর পরের বছরগুলোতে পাসের হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু তিন বছর—২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮—৭০ শতাংশের নিচে নেমেছিল।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পরীক্ষা সরাসরি নেওয়া হয়নি, তাই ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাই উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালে ভিন্ন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়, এক বছরে পাসের হার ৮৪ শতাংশের বেশি, আর অন্য বছরে ৯৫ শতাংশের বেশি হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে তা আবার ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আর এ বছর তা পৌঁছেছে ৫৭ শতাংশে, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
![]() |
এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর মুঠোফোনে নিজেদের ফলাফল খুঁজছেন এক শিক্ষার্থী। পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠ, রংপুর, ১৬ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে পরীক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি অকৃতকার্য হয়েছেন। এ কারণে সার্বিক ফলাফলের ওপর বড় প্রভাব পড়েছে।
গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে, পরীক্ষার্থীদের চাপের কারণে মাঝপথে বাতিল করা হয়েছিল এইচএসসিতে স্থগিত থাকা কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা। তখন যেসব বিষয়ে পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। আর যেসব বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল তৈরি করা হয় পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় অনুযায়ী।
এই প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত ফলাফলে অনেকের ধারণা ছিল পাসের হার অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার ২০২৩ সালের চেয়ে কমে গেছে। ফলাফলের সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
এ বছর শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমে গেছে। গত বছর ১,৩৮৮টি প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থী পাস করেছিলেন, এ বছর তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪৫-এ।
অন্যদিকে, শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২-এ, যা গত বছর ছিল মাত্র ৬৫টি।
![]() |
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে এসে মুঠোফোনে ফলাফল দেখছেন দুই শিক্ষার্থী। সরকারি আজিজুল হক কলেজ উচ্চমাধ্যমিক ভবন চত্বর, বগুড়া, ১৬ অক্টোব | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির ফলাফল প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা কাউকে কোনো ছক বা নির্দেশ দিইনি যে এইভাবে নম্বর দেবেন বা ওভারমার্কিং করবেন, যাতে পাসের হার বেশি হয়। এমন কোনো প্রশ্নও ওঠে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত এসএসসি পরীক্ষার সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, নিয়ম মেনে চলতে হবে। বোর্ড পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের নিয়ম মনে করিয়ে দিয়েছে। সঠিক মূল্যায়নের জন্য এবার সময়ও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
প্রায় অর্ধেক পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি, আবার গ্রাম-শহরের ফলাফলেও বড় তারতম্য দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, এটা কি দেশের শিক্ষায় বড় কোনো গলদের চিহ্ন কি না। জবাবে অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করল না, এটা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত নয়। এতে আমরা নিজের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। বোঝা যাচ্ছে, গলদ আছে, অবশ্যই আছে। সেই গলদগুলো ঠিক করা দরকার। দায়িত্বটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বোর্ড এবং সবার।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন