[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে শেষ বিদায়

প্রকাশঃ
অ+ অ-


ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে আহমদ রফিকের কফিন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা। ৪ অক্টোবর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জীবনের শেষ দিনগুলোতে ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র–গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক ছিলেন একা। তবে বিদায়ের দিনে তাঁর অসংখ্য অনুরাগী ও সুহৃদ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বেদনাহত হৃদয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে অনেকেই অংশ নেন তাঁর অন্তিমযাত্রায়।

আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে বারডেম থেকে আহমদ রফিকের মরদেহ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এর আগেই ফুল হাতে তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীরা অপেক্ষা করছিলেন মিনার প্রাঙ্গণে। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছিল, তার উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন তখনকার তরুণ চিকিৎসাশিক্ষার্থী আহমদ রফিক। ৭৩ বছর পর সেই মিনারেই শেষবারের মতো আনা হলো তাঁর মরদেহ। ফুলে ঢেকে যায় তাঁর কফিন। শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে বারডেম হাসপাতালে মারা যান তিনি। বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। আহমদ রফিক ছিলেন নিঃসন্তান ও বিপত্নীক।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সচিব আবুল ফয়েজ মো. আলাউদ্দিন খান প্রথমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, ছাত্র–যুব সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও অসংখ্য মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভাষাসংগ্রামী হিসেবে তাঁর পরিচয়ই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, তবে তিনি আমাদের দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখকও ছিলেন। তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন, সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। রবীন্দ্র–গবেষক হিসেবে তাঁর কাজ দুই বাংলাতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক ভাবনা সবসময় সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। তিনি আমাদের সংগ্রামের প্রেরণা ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।’
আহমদ রফিককে শেষ শ্রদ্ধা জানান ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
অধ্যাপক মনসুর মুসা বললেন, আহমদ রফিকের মতো দেশপ্রেমিক মানুষ এখন বিরল। তিনি সবাইকে ভালোবেসে একত্র করে কাজ করতে পছন্দ করতেন এবং মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে, মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতেন। এটাই তাঁর প্রকৃত সমন্বয়। এমন সমন্বয়ধর্মী গুণের মানুষ সহজে পাওয়া যায় না। সবাইকে নিয়ে একত্রে থাকার শিক্ষা তিনি দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, গণমানুষের মুক্তির জন্য যে আদর্শ আহমদ রফিক লালন করেছেন, তাতে তিনি ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। দেশ ভাগ তাঁকে ব্যথিত করেছিল। আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এই কারণে তাঁর গবেষণা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। নিজের জীবনই তিনি মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, আহমদ রফিক ভাষাসংগ্রামী ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনন্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে আমৃত্যু কাজ করেছেন। ভদ্র ও শোভন জীবনযাপন করেছেন। নিজের সম্পত্তি অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিবারের পক্ষে আহমদ রফিকের ভাতিজি রেহেনা আক্তার বলেন, এত মানুষকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে দেখে পরিবার অভিভূত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁর ভাগনে হুমায়ূন কবির অনলাইনে বলেন, তাঁর মামা ছিলেন নির্মোহ মানুষ। যাঁরা বিভিন্ন সময় তাঁর সহায়তা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী বলেন, আহমদ রফিক ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানায় বিশ্বাস করতেন না। যা ছিল, তা বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তিগতভাবে অনেককে দান করেছেন। নিজের ভবিষ্যৎ ভাবেননি। জীবনের শেষ দিনগুলো তাঁর ভালো কাটেনি। এখন তাঁর রচিত গ্রন্থই তাঁর সম্পদ, যা সমাজকে আলোকিত করেছে এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

চিকিৎসক শাকিল আক্তার স্মৃতিচারণা করেন। ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুনীর সিরাজ বলেন, জীবনের শেষ দিনগুলো আহমদ রফিক নিঃসঙ্গ ছিলেন। তবে আজ তাঁর নিঃসঙ্গতা নেই। এত মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে উপস্থিত হয়েছেন, যা সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো।
 
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আহমদ রফিকের মরদেহ নিয়ে অনুরাগীদের শোকযাত্রা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। এ ছাড়া শতাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রয়াত ভাষাসংগ্রামীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এর মধ্যে ছিল ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কপি রাইটস অফিস, জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, লেখক শিবির, একুশের চেতনা পরিষদ, ছায়ানট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, প্রথম আলো, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রগতি লেখক সংঘ, বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, খেলাঘর কেন্দ্রীয় সংসদ, অন্য প্রকাশ, অনিন্দ্য প্রকাশ, বিদ্যাসাগর পাঠাগার, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মুক্ত আসর, ষড়ঋতু উদ্‌যাপন জাতীয় পরিষদ, কামাল লোহানী পরিবার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, জাতিসংঘ সমিতি, ডাকসু, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয় গণফ্রন্ট, জাতীয় গণফ্রন্ট, মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ মার্ক্সবাদী, শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, গণসংহতি আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, গণফোরাম, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি, যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট প্রভৃতি।

বেলা একটায় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয়। এই পর্বটি সঞ্চালনা করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। আগেই জানানো হয়েছিল ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক তাঁর মরদেহ ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করে গেছেন। মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রা করেন তাঁর অনেক অনুরাগী। শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর, শিশু একাডেমি, জাতীয় ঈদগাহের সামনে দিয়ে কদম ফোয়ারার মোড় ঘুরে তোপখানা রোড দিয়ে সেগুনবাগিচায় হাসপাতালে আসে শোকযাত্রা। হাসপাতালের চিকিৎসক আবু সাঈদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে মরদেহ হস্তান্তর করে বিষণ্ন চিত্তে ফিরে যান তাঁর অনুরাগীরা।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন