তিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার শেখ হাসিনার
|  | 
| বার্তা সংস্থা রয়টার্সে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনের একটি অংশের স্ক্রিনশট | 
গত বছর জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার একযোগে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্ট। ই–মেইলের মাধ্যমে নেওয়া এসব সাক্ষাৎকারে তিনি গণ–অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতার হত্যাকাণ্ড, আসন্ন নির্বাচন, দেশে ফেরা, ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে লিখিতভাবে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এটি  দেশত্যাগ করে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার।
তিনটি সাক্ষাৎকারেই শেখ হাসিনা একই ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি কোনো ঘটনার দায় নেননি, অনুশোচনাও করেননি। ছাত্র–জনতার হত্যার জন্য দায়ী করেছেন মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। এমনকি গণ–অভ্যুত্থানকে তিনি ‘সহিংস বিদ্রোহ’ বলে উল্লেখ করে এর দমনকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।
নিজে পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করলেও এবার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চেয়েছেন। প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে বিভেদ বাড়ালেও এখন বলছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে দেশে বিভেদ আরও বাড়বে।
ক্ষমা চাইতে অস্বীকার
দ্য ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ১৫ বছরের বেশি সময় কঠোরভাবে দেশ শাসন করা শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে আছেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, গত বছর নিহত আন্দোলনকারীদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, তখন হাসিনা বলেন, 'আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই–বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।' 
সাক্ষাৎকারে তিনি বিক্ষোভ দমনের সময়কার কর্মকাণ্ডের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে কোনো ব্যক্তিগত দায় স্বীকার করেননি। তাঁর ভাষায়, আন্দোলনটি ছিল একটি সহিংস বিদ্রোহ।
শেখ হাসিনার দাবি, বেশি প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিল মাঠপর্যায়ের নিরাপত্তা বাহিনীর ‘শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া’। তিনি বলেন,'একজন নেতা হিসেবে আমি অবশ্যই সামগ্রিক দায় স্বীকার করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—যে আমি নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালাতে বলেছিলাম, এটা ঠিক নয়।' 
তাঁর দাবি, প্রথম দিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর সরকারই একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করেছিল, কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও শেখ হাসিনা প্রায় একই কথা বলেন। তাঁর ভাষায়, 'আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি—এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।' 
তবে তিনি স্বীকার করেন, 'চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল পরিমিত, সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যতটা সম্ভব প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে।' 
তিনি আরও বলেন, 'মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যাঁদের নিজস্ব নির্দেশিকা মেনে চলার কথা ছিল। এসব নির্দেশিকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন ছিল। জটিল অবস্থায় কিছু সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে।' 
নিজের বিচার প্রসঙ্গে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিচার চলছে। অভিযোগপত্রে তাঁকে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী বলা হয়েছে। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আবেদনও করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন।
তবে শেখ হাসিনা এই সংখ্যা ‘অতিরঞ্জিত’ বলে দাবি করেছেন। তাঁর ভাষায়, 'এই সংখ্যা ট্রাইব্যুনালের প্রচারণার কাজে লাগে, কিন্তু বাস্তবে তা বাড়িয়ে বলা।' 
|  | 
| শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ইনডিপেনডেন্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশের স্ক্রিনশট | 
এ নিয়ে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, 'যদি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাতে আমি অবাক হব না বা ভয়ও পাব না। এটি একটি প্রহসনের বিচার, যার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনাল একটি প্রহসনের আদালত, যেটি পরিচালনা করছে আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে গঠিত একটি অনির্বাচিত সরকার। এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেই আমাকে সরাতে যেকোনো কিছু করতে পারে।' 
দ্য ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, আদালতে এমন অডিও রেকর্ডিং বাজানো হয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন। তবে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, এই রেকর্ডিংগুলো প্রসঙ্গের বাইরে কেটে নেওয়া ও বিকৃত করা হয়েছে। তাঁর ভাষায়, 'সহিংসতা ঘটেছে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে, সরকারের আদেশে নয়।'
দ্য ইনডিপেনডেন্ট মন্তব্য করেছে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণা হবে এবং সম্ভবত তিনি জানেন, ইতিহাস তাঁকে সদয়ভাবে বিচার করবে না। যদিও শেখ হাসিনা বলেছেন, 'সহিংস বিদ্রোহের মুখে দেশ রক্ষায় সাংবিধানিক কর্তব্য পালনের জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত নয়।' 
শেখ হাসিনা সব দায় অস্বীকার করলেও দ্য ইনডিপেনডেন্ট লিখেছে, গত বছর বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর যে দমন–পীড়ন চালানো হয়েছিল, তা বিশ্বকে শোকার্ত করে তুলেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ–আঞ্চলিক পরিচালক বাবু রাম পান্ত বলেছিলেন, বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা দেখায় বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ভিন্নমতের প্রতি কতটা অসহিষ্ণু। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেছিলেন, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা বিশেষভাবে দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ চলাকালে বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হন। এসব হতাহতের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। এটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস ঘটনা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা সরকারকে বিরোধীদের দমন, রাজনৈতিক হত্যা, বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার ও একতরফা নির্বাচনের জন্য দায়ী করে আসছিল।
দেশত্যাগ ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে
সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ায় তিনি দেশ ছাড়েন। রয়টার্সকে তিনি বলেন, 'থেকে গেলে আমার জীবন যেমন ঝুঁকিতে পড়ত, আশপাশের মানুষদের জীবনও তেমনি বিপদে পড়ত।' 
তবে নির্বাসনে থেকেও তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর ভাষায়, 'শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই দেশকে ঠিক করতে পারে।' 
রয়টার্সকে শেখ হাসিনা আরও বলেন, 'কোনো সরকার যদি এমন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়, যেখানে আমার দল থাকবে না, তবে আমি সেই সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ফিরব না। আমি ভারতে থাকার পরিকল্পনা করেছি।' 
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একদিন আবার বাংলাদেশের ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখবে, সরকারে থাকুক বা বিরোধী দলে। আর এই দল পরিচালনায় তাঁর পরিবারের প্রয়োজন নেই। এটা আমার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সংবিধান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।' 
রয়টার্স উল্লেখ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা শেখ হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ গত বছর বলেছিলেন, দল চাইলে তিনি নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করতে পারেন।
ভোট বর্জন
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে তাদের লাখ লাখ সমর্থক নির্বাচন বর্জন করবে। তাঁর ভাষায়, 'আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অবিচারই নয়, এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনী বৈধতা থাকতে হবে। লাখ লাখ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এখন যে অবস্থা রয়েছে, তাতে তারা ভোট দেবে না। আপনি যদি একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চান, তাহলে লাখ লাখ ভোটারকে বঞ্চিত করতে পারেন না।' 
তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, 'আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে। আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্যান্য দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি, বোধোদয় হবে এবং আমাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে।' 
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগসহ সব বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর ভাষায়, 'আমার দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা মানে দেশে ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বপন করা।' 
গুম নিয়ে কথা বলেননি
রয়টার্স জানিয়েছে, শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর তাঁর সমর্থকদের ওপর বড় ধরনের দমন অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে অভিযানে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করে, যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র অস্থিতিশীল করার অভিযোগ ছিল।
তবে রয়টার্স বলেছে, নিজের শাসনামলে গোপন বন্দিশালায় নিখোঁজ হওয়া শত শত মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে শেখ হাসিনা কিছুই বলেননি।
 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন