বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
![]() |
| বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পতাকা |
প্রায় ২০ বছর পর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠক। বৈঠকে অংশ নিতে ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী আহাদ খান চিমা। আগামী ২৭ অক্টোবর ঢাকায় নবম জেইসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকা সফরকালে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। জেইসি বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো, কৃষিতে সহায়তা, আর্থিক সেবা, ব্যাংকিংসহ সংশ্লিষ্ট খাতে আলোচনা হতে পারে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ২০০৫ সালের পর পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনও জেইসি বৈঠক হয়নি। সম্পর্ক ও সহযোগিতা স্বাভাবিক করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ইতোমধ্যে দেশটির চারজন মন্ত্রী ঢাকা সফর করেছেন। বিগত সরকারের সময়ে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি ছাড়া আর কোনও মন্ত্রী ঢাকায় আসেননি। তবে সেই সফরগুলো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছিল না। তাই এবারের জেইসি বৈঠকটি সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
অপরদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের আমন্ত্রণে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ২৮ অক্টোবর পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন। তার সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সম্পর্ক নতুন করে উজ্জীবিত করতে গত এপ্রিলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ঢাকায় সফর করেছিলেন। এরপর আগস্টে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ঢাকায় এসেছেন। জুলাইয়ে ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন রাজা নকভি। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সভায় যোগ দিতে ঢাকায় আসলেও তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন।
গত এপ্রিলে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী ঢাকায় এসে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প পাকিস্তানের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী আমদানিতেও সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।’ তিনি ত্রিপাক্ষীয় বাণিজ্য উদ্যোগের মাধ্যমে আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার বাজারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান একসঙ্গে কাজ করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।
তিনি তখন বাংলাদেশের কাছে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসন্ন জেইসি বৈঠকে পাকিস্তানকে আরও বেশি করে শুল্কমুক্তভাবে চা, পাটজাত পণ্য, ওষুধ, তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য অনুরোধ করা হবে।
এছাড়া নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন প্রতিষ্ঠা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নতুন খাত সংযোজন, শুল্ক ও অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার এবং যৌথ বিনিয়োগের বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হতে পারে। পাকিস্তানের করাচি বন্দর ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর বিষয়টিও বৈঠকে চূড়ান্ত হতে পারে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পাকিস্তান ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রফতানি হয়েছে ৬৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাকের কাপড়, সুতা ও সিমেন্ট। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয় পাট এবং অন্যান্য টেক্সটাইল ফাইবার, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। এটি আমাদের জন্যও লাভজনক। কারণ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার। আমরা বেশি আমদানি করি, কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে খুব কম রফতানি হয়। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের উন্নতি হলে বাণিজ্য বাড়বে এবং সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে পর্যটক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগও বেড়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, শিল্প কাঁচামাল, চাল এবং অন্যান্য পণ্য আমদানিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই পাকিস্তানের দিকে নজর দিচ্ছে। পাকিস্তান থেকে পাথর ও খনিজসম্পদ আমদানের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। তবে বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব এখনও নিশ্চিত নয়। তাঁর মতে, বন্দর ব্যবহার করলে সবাই লাভবান হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৫ সালের পর দুই দেশের আর কোনও জেইসি বৈঠক হয়নি। তাই এবারের বৈঠক দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, 'পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই। সেই স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে সফর অন্তর্ভুক্ত। তারা যদি আসে, আমরা স্বাগত জানাবো—এটাই স্বাভাবিক এবং আমরা তাই করছি।'
তিনি আরও বলেন, ''আমরা চাই অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ুক। এতদিন এটা অনেকটা একপক্ষীয় আটকে রাখা হয়েছিল। আমাদের স্বার্থ আছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তা এগিয়ে নেওয়ায়। আমার মনে হয় আমরা সেই দিকেই এগোচ্ছি।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন