[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

জুলাই সনদে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি

প্রকাশঃ
অ+ অ-

জুলাই সনদ | গ্রাফিকস: পদ্মা ট্রিবিউন 

দীর্ঘ সংলাপের পর অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। ওই সনদে স্বাক্ষরের সম্ভাব্য দিনক্ষণও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো এক জায়গায় আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ অবস্থায় তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতেও সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।

১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে—গত বৃহস্পতিবার এমন ঘোষণা দিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। তবে গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর জানানো হয়, সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য বুধবারের পরিবর্তে শুক্রবারে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। যদিও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতপার্থক্য কমাতেই সময় দুই দিন বাড়ানো হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই ধাপের সংলাপের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে ৮৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে দলগুলোর আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) অন্তর্ভুক্ত আছে। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদসহ বামপন্থী দলগুলো জানিয়েছে, তারা আপত্তিসহ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলগুলো স্বাক্ষরে ইতিবাচক থাকলেও জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য ও বাস্তবায়নের সুপারিশ দেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে।

সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে সংশয় নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দলগুলোকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হবে। আলী রীয়াজ বলেন, ‘দলগুলোর বক্তব্য আমরা আমলে নিয়েছি। জাতীয় সনদে ভিন্নমত থাকবে, এবং তার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কী কারণে আপত্তি, সেটাও উল্লেখ করেছি। ফলে দলিলে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে। আমরা আশা করি, প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করবে।’

জুলাই সনদকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের আগেই এই সনদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরে জামায়াত ইতিবাচক হলেও দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে চান বলে জানিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, ‘স্বাক্ষরের বিষয়ে আমরা এখনো চূড়ান্ত করিনি। এখনো সময় আছে, তাড়াহুড়ো নেই। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও আপত্তি বিবেচনা করে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। তবে সনদের মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়নে গড়িমসি হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করব।’

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। জুলাই জাতীয় সনদে মূলনীতির অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিপক্ষে সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদ। তারা বলছে, সনদে আপত্তির বিষয়গুলো থাকলে স্বাক্ষর করবে না। এ ছাড়া কমিশনের প্রস্তাবিত সংবিধানের ৪ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের বিরোধিতাও করছে দলগুলো, যেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি (ছবি) অপসারণের কথা বলা আছে। এসব বিষয় নিয়ে আজ দলগুলো বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুল রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য আমাদের মনমতো হলে স্বাক্ষর করব, না হলে করব না।’

বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদে যদি সর্বসম্মতভাবে একমত হওয়া বিষয়গুলো থাকে, তাহলে আমরা স্বাক্ষর করব। নোট অব ডিসেন্টসহ সনদে আমরা স্বাক্ষর করব না।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ধাপে পাঁচ দিন সংলাপ করেছে কমিশন। সেখানে গণভোটের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও সময় নিয়ে মতভেদ ছিল। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ভোটের দিন গণভোট চেয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ভোটের আগেই গণভোট চেয়েছে।

গণভোট নিয়েও দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। কমিশন প্রথমে ‘একমত ও আপত্তি’—এই দুই বিষয়ে গণভোট করার কথা ভাবছিল। দুটি আলাদা প্রশ্নে জানতে চাওয়া হবে, এগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। তবে এখন কমিশন একটি প্রশ্ন রাখার চিন্তা করছে। সূত্র জানায়, সেটি হলো—পুরো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না? সেখানে ভিন্নমতসহ সব সিদ্ধান্ত থাকবে। যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়, তাহলে ৮৪টি প্রস্তাব যেভাবে ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেভাবেই বাস্তবায়ন করা হবে। সে ক্ষেত্রে ভিন্নমত আর বিবেচনায় আসবে না। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে বিশেষ আদেশের ভিত্তিতে এই গণভোটের সুপারিশ করবে কমিশন।

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে মতপার্থক্য কমাতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে কমিশন। এর মধ্যে গত শনিবার ও রোববার জামায়াতের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া শনিবার এনসিপি ও রোববার বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হয়। এসব বৈঠকেও দলগুলো গণভোটের বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি। তবে কমিশন আশা করছে, গণভোটের ভিত্তি, বিষয় ও সময় নিয়ে মতভিন্নতা কমে আসবে। কমিশন চারটি বিষয়ে আলোচনা করছে—গণভোট করা হবে কি না, কিসের ভিত্তিতে হবে, কী বিষয়ে হবে এবং কখন হবে।

গতকাল দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে তিনি ভোটের দিন গণভোটের পক্ষে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, একই দিনে গণভোট হলে রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয় হবে। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হলে ভোটের হার কমে যাবে।

এ দিন বিকেলে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ ও আইনজীবী শিশির মনিরের সঙ্গে কমিশনের সদস্যরা দ্বিতীয় দিনের বৈঠক করেন। সেখানে নেতারা ভোটের আগেই গণভোটের পক্ষে দলের যুক্তি আবারও তুলে ধরেন। বৈঠক শেষে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত। নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে আমরা কর্মসূচি দিয়েছি।’

অনানুষ্ঠানিক আলোচনা বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি, যেন মতপার্থক্য কমিয়ে দ্রুত সনদ বাস্তবায়নের পথে এগোনো যায়।’

গণভোটের পর জুলাই সনদ সংবিধানসংক্রান্ত বিষয়গুলো সমাধানে পরবর্তী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ক্ষমতার সুপারিশ করবে কমিশন। সূত্র জানায়, সংবিধান সংস্কার পরিষদের কাজ শেষ করতে ছয় মাস সময় নির্ধারণের পক্ষে তারা। না হলে সংস্কার ঝুলে যাবে। কমিশনের মতে, প্রথম অধিবেশনে সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাব পাসের বাধ্যবাধকতা দেওয়া ঠিক হবে না। তারা ভাবছে, সংসদ গঠনের বা প্রথম বৈঠকের দিন থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার শেষ করার সময় নির্ধারণ করা যায়। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে এই সময় বাড়ানো বা কমানো হতে পারে। 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন