[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

নির্যাতন–হয়রানিতে থমকে যাচ্ছে নারী অভিবাসন, কমেছে অর্ধেক

প্রকাশঃ
অ+ অ-

নারী নির্যাতন প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজারো নারী জীবিকার খোঁজে পাড়ি জমান বিদেশে। তাদের বড় একটি অংশ কাজ করেন গৃহকর্মী কিংবা পোশাক শ্রমিক হিসেবে। প্রধান গন্তব্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান ও লেবানন।

এক দশক আগেও প্রতিবছর এক লাখের বেশি নারী বিদেশে কাজে যেতেন। এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে এ শ্রমবাজার। বিদেশের কর্মক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়া, দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা, পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া, এমনকি যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে নারী অভিবাসনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, অনেকের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে মাঝপথে।

পিতার মৃত্যুর পর সংসারের ভার কাঁধে তুলে নেন শারমিন সুলতানা। বছর তিনেক আগে গৃহকর্মীর ভিসায় যান সৌদি আরবে। পরিবার বলতে তাঁর মা আর ছোট ভাই। টানাপোড়েনের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে গত বছর ১০ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি। তবে ফেরেন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর এক বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় একদিন পর মায়ের কাছে ফিরতে পারেন তিনি। এখনো চলছে তাঁর মানসিক চিকিৎসা। মাঝেমধ্যেই হঠাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, পরিবারের সঙ্গে আচরণ করেন অস্বাভাবিকভাবে। বিদেশে গিয়ে ভাগ্য গড়তে চাওয়া ২২ বছরের এ তরুণীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

শারমিনের মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন আরও অনেক নারী অভিবাসী। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) প্রতিনিয়ত জমা পড়ছে একই ধরনের অভিযোগ। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির ‘অভিবাসীদের ন্যায়ের আর্তনাদ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব তথ্য—বিদেশে কর্মরত নারী অভিবাসীরা নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, সামান্য কারণে নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে আসত থাপ্পড়, ঘুষি, লাথি কিংবা বেল্ট, চাবি, জুতা দিয়ে আঘাত। দেশে ফেরত আসা কয়েকজন নারী গৃহকর্মী বলেছেন, কীভাবে তাদের চুল ধরে টেনে দেয়ালে মাথা ঠুকে দেওয়া হতো। কারও শরীরে ঢেলে দেওয়া হতো গরম পানি কিংবা ফুটন্ত তেল। আবার ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ায় কারও হাড় ভেঙে গেছে, কেউ ভুগেছেন অসহনীয় মানসিক নির্যাতনে, অনেকে হয়েছেন যৌন হয়রানির শিকার।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) এক গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। বিশেষ পরিস্থিতিতে ফিরে আসা ৯৪ শতাংশ নারী কর্মীই জানিয়েছেন, তাঁরা প্রবাসে নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৭ শতাংশ নারী। অসুস্থ হলেও চিকিৎসা পাননি ৯৭ শতাংশ। পর্যাপ্ত খাবার পাননি ৮০ শতাংশ নারী, ভোর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত টানা কাজ করতে হয়েছে ৮২ শতাংশকে। খাবার–পানি ছাড়া রুমে আটকে রাখা হয়েছে ১৫ শতাংশ নারীকে। সপ্তাহে ছুটির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৯৭ শতাংশ কর্মী। এর পাশাপাশি বিদেশ যাওয়ার আগে বেশির ভাগ নারী কর্মীকেই চাকরির চুক্তিপত্র দেওয়া হয়নি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, কর্মসংস্থানের জন্য ২০১৬ সালে বিদেশে যান ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ নারী কর্মী। তবে এক দশক পর ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মী গেছেন মাত্র ৪০ হাজার ৮৮ জন—যা প্রায় ৬৬ শতাংশ কম। গত বছর ২০২৪ সালে কর্মী গিয়েছিলেন ৬১ হাজার ১৫৮ জন, ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ১০৮ এবং ২০২২ সালে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন। এর আগে করোনার প্রভাবে ২০২১ ও ২০২০ সালে কিছুটা কম নারী কর্মী গিয়েছিলেন—ক্রমশ ৮০ হাজার ১৪৩ ও ২১ হাজার ৯৩৪ জন। অথচ মহামারির আগের চার বছরেই প্রতিবছর এক লাখের বেশি নারী গিয়েছিলেন বিদেশে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬, ২০১৮ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৫ এবং ২০১৭ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরে তারা শতাধিক প্রবাসী নারীকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে, যাদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এঁরা সবাই বিদেশে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। কেউ অতিরিক্ত কাজের চাপ ও কম মজুরির কারণে গুরুতর মানসিক আঘাতে (ট্রমা) ভুগছেন।

আট বছরের তামিম ও ছয় বছরের তানজিমকে রেখে ২০২৩ সালে লেবাননে গিয়েছিলেন গাজীপুরের তসলিমা হারুন। মেডিকেলে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁকে রাখা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্লিনারের কাজে। সেখানে ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়, বরং শিকার হতে হয়েছে নানা নির্যাতনের। মাত্র এক মাস ১৩ দিন পরই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন তসলিমা।

তসলিমার বাবা হারুন বলেন, ‘আমার মেয়ে ও নাতিদের নিয়ে এখন বিপদে আছি। মেয়েটা মানসিক টেনশন করে, ঠিকমতো খায় না, শরীরও ভালো থাকে না। আমার বয়স ৬৫, মেয়েটাকে নিয়ে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। তার ওপর এক লাখ টাকা ঋণও আছে।’

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানিসহ নানা নিপীড়নের কারণে অনেক নারী কর্মী আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিদেশ থেকে দেশে এসেছে ৪১২ নারী অভিবাসী কর্মীর মরদেহ। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৮৪ জন।

বছরভিত্তিক হিসাব বলছে—২০২১ সালে দেশে ফেরত আসে ৪৯ নারী শ্রমিকের মরদেহ, এর মধ্যে ৯ জন আত্মহত্যা করেন, ২০২২ সালে দেশে ফেরে রেকর্ড ১০৯ নারী শ্রমিকের মরদেহ, আত্মহত্যা করেন ৩৪ জন, ২০২৩ সালে মারা যান ১০১ নারী শ্রমিক, এর মধ্যে ২০ জন আত্মহত্যা করেন, ২০২৪ সালে দেশে ফেরে ৯৫ মরদেহ, আত্মহত্যা করেন ১৫ জন, আর ২০২৫ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশে এসেছে ৫৮ নারী শ্রমিকের মরদেহ, তাঁদের মধ্যে ৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।

প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কারণে মৃত্যু হয় প্রবাসী শ্রমিকদের। স্বাভাবিক মৃত্যুর পাশাপাশি দুর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিদেশে মারা যাওয়া বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের মৃত্যু সনদের তথ্য অনুযায়ী, ৬৯ শতাংশের মৃত্যু দেখানো হয়েছে ‘স্বাভাবিক’ বলে।

তবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষণা বলছে, বিদেশে মারা যাওয়া নারী শ্রমিকদের পরিবারগুলোর ৪৮ শতাংশই এই তথাকথিত ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’কে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের দাবি, এর পেছনে রয়েছে নির্যাতন, অবহেলা কিংবা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।

নারী অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শ্রমচুক্তি আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় আলাপে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। নারীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনের কার্যকারিতা থাকলে সমস্যাগুলো অনেকটাই কমে আসবে। জবাবদিহি থাকলে নিয়োগকর্তারা যা খুশি তা করতে পারত না।’

আসিফ মুনীর আরও বলেন, ‘সৌদি আরবে নারী কর্মীরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবেই যান। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ, ভাষা, কাজের ধরন সবই আলাদা। বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে কাজ করার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সৌদির কাজের পরিবেশের কোনো মিল নেই। অনেক নারী কর্মী সেখানে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী দুজনের কাছ থেকেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। কেউ যৌন নির্যাতনের শিকার হন গৃহকর্তার দ্বারা। এসব ঘটনায় অনেক কর্মী মানসিক ট্রমার ভেতর দিয়ে যান। কিন্তু বেশির ভাগ নারী নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন না, চেপে রাখেন ভেতরে—ফলে দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে হয়।’ 

বিদেশে নারী কর্মীদের বঞ্চনার গল্প চাপা পড়ে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির সাফল্যের আড়ালে। গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসেরও কম সময়ে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এই রেমিট্যান্সে ভর করে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিতে ভারসাম্য এসেছে, ডলারের বিনিময় হারও স্থিতিশীল হয়েছে।

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী মনে করেন, নতুন শ্রমবাজার তৈরি না হওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক নারী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরছেন। ফলে তাঁদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে, যে কারণে বিদেশ যেতে অনাগ্রহী হচ্ছেন। গৃহকর্মী হিসেবে যেসব দেশে তাঁরা কাজ করেন, সেসব দেশে অধিকার ও সহিংসতার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্র ও বেসরকারি খাতের উচিত ছিল যেসব দেশে হয়রানি-নির্যাতন কম, সেই শ্রমবাজার খুঁজে বের করা। যেমন ফিলিপাইন গৃহকর্মীর বদলে অন্য পেশায় নারী কর্মী বেশি পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবেই নারী অভিবাসন কমছে। আগে গার্মেন্টস ও ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানাগুলোতে নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, এখন কমে ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে। নারী অভিবাসন কমে যাওয়ার কারণগুলো নিয়ে বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করা দরকার।’ 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন