{getBlock} $results={3} $label={ছবি} $type={headermagazine}

একই বৃষ্টিতে তানোরে পানি কম, গোদাগাড়ীতে বৃদ্ধি

প্রকাশঃ
অ+ অ-

রাজশাহীর তানোর উপজেলায় সুপেয় পানির সংকটের কারণে গভীর নলকূপ থেকে পানি আনতে যাচ্ছেন কয়েকজন নারী। সম্পতি মুন্ডুমালা পৌর এলাকার মাহালেপাড়ায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

‘এই বছরে ম্যালা বৃষ্টি হইচ্ছে, লোকজন ধান লাগাচ্ছে। কিন্তুক ডিপটিউবল (নলকূপ) আর চলছে না। খালি ভ্যাকাম ভ্যাকাম (শব্দ) কইরছে। এই ধারে ভবিষ্যৎ কি কেউ জানে না?’ নিজের এলাকায় পানির সংকট নিয়ে আশঙ্কার কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার উচ্চাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক জীবল মারান্ডী।

শুধু উচ্চাডাঙ্গা নয়, তানোরের আরও কিছু এলাকায় একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে। অনেক বাসিন্দা বলেছেন, সরকারের স্থাপন করা গভীর নলকূপ ছাড়া তাঁরা সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। চলতি বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলেও মাটির নিচে পানির স্তর ওপরে ওঠেনি।
তবে এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে পাশের গোদাগাড়ী উপজেলায়। গত ১৯ বছরের মধ্যে সেখানে পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে ওপরে উঠেছে।

সম্প্রতি দেশের তিনটি অঞ্চলকে ‘পানি সংকটাপন্ন’ হিসেবে ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে সরকার। এগুলোর মধ্যে তানোর ও গোদাগাড়ীও আছে।

পানি সংকটাপন্ন এলাকা  
পানি সংকটাপন্ন এলাকা হলো এমন অঞ্চল যেখানে সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে তা আরও বাড়ছে। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩-এর অধীনে, এই ধরনের এলাকাগুলো সরকার কর্তৃক চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনা, ব্যবহার ও সংরক্ষণে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করা হয়।

গবেষকেরা বলছেন, মাটির নিচের পানি ধারক স্তর বা ‘অ্যাকুইফার’ মারা যাওয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলেও মাটির নিচে আর পানি জমে না। বৃষ্টি কমে গেলে কিংবা সেচের কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থার তৈরি হয়।

সুইজারল্যান্ড সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন ও সুইস রেডক্রস যৌথভাবে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণার জন্য জরিপ করে। ‘সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’–এর আওতায় প্রতিবেদনটি সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন পর্যায়ের কাজ করেছে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)। 

এ জরিপের ভিত্তিতে নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচল ও গোমস্তাপুরকে পুরোপুরি পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম খান, প্রকল্পটির সমন্বয়কারী ও ডাসকো কর্মকর্তা

প্রকল্পটির সমন্বয়কারী ও ডাসকো কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এ জরিপের ভিত্তিতে নওগাঁর পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচল ও গোমস্তাপুরকে পুরোপুরি পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও ভোলাহাট, চট্টগ্রামের পটিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলকে আংশিক পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওয়ারপোর নীতিমালার আলোকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এসব এলাকায় পানি রেশনিং করেছে। গত ২৫ আগস্ট জাতীয় পানিসম্পদ নির্বাহী কমিটি এলাকাগুলোকে পানি সংকটাপন্ন ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) কর্মকর্তা আল আমিন কবীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তানোরে পানির স্তর কেন নামছে 

গবেষকেরা বলেন, তানোর ও গোদাগাড়ীকে উঁচু বরেন্দ্রভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তানোর উপজেলা সদরের উচ্চতা ২৫ মিটার ও গোদাগাড়ীর উচ্চতা ২০ মিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু এলাকা উচ্চাডাঙ্গা গ্রামটি তানোরে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৫২ মিটার।

বিএমডিএ বলছে, চলতি বছর তানোর ও গোদাগাড়ীতে বৃষ্টি হয়েছে গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত গোদাগাড়ীতে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬১৫ মিলিমিটার। এ বছর সেখানে হয়েছে ১ হাজার ৩৫৬ মিলিমিটার। একই সময়ে তানোরে ২০১৫ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১ হাজার ৩০৭ মিলিমিটার, আর চলতি বছর হয়েছে ১ হাজার ১৫৬ মিলিমিটার। ২০১৫ সালের পর এই ১০ বছরে উভয়স্থানেই চলতি বছর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। 

সাধারণত এক বছরে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়, পরের বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে সেই স্তরটি পুনর্ভরণ বা রিচার্জ হওয়ার কথা। তবে বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেই ‘রিচার্জ’ আর হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, অঞ্চলটিতে প্রতিবছর একটু একটু করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্ষার পর তা আর আগের জায়গায় ফিরছে না। ফলে পানি ধারক স্তরের মোটা বালু ধূলিতে পরিণত হচ্ছে। এরপর যতই বৃষ্টি হোক, ওই স্তর আর পানি ধারণ করতে পারে না। তখন বুঝতে হয়, পানি ধারক স্তরটি মারা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় প্রায় ২০টি স্থানে পানি ধারক স্তরের মৃত্যু হয়েছে।

গবেষণা চলাকালে তানোর উপজেলার তিনটি জায়গায় নিয়মিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মাপা হয়। এগুলো হলো কামারগাঁ ইউনিয়নের হরিপুর, তানোর পৌর এলাকার তালন্দ এবং বাধাইড় ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রাম।

গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক বছরে প্রতিটি জায়গাতেই পানির স্তর আরও নিচে নেমেছে। হরিপুরে গত বছর পানির স্তর ছিল মাটির ৬০ ফুট ২ ইঞ্চি নিচে, এবার তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৬১ ফুট ৮ ইঞ্চিতে। তালন্দে গত বছর ছিল ৫৮ ফুট ৫ ইঞ্চি, এ বছর হয়েছে ৬৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। আর নারায়ণপুরে গত বছর ছিল ১০৮ ফুট ৯ ইঞ্চি, এখন নেমে গেছে ১১৪ ফুট ৯ ইঞ্চিতে। অর্থাৎ বৃষ্টি বাড়লেও মাটির নিচে পানি জমছে না, বরং আরও কমে যাচ্ছে। গবেষকেরা বলছেন, এ পরিস্থিতি তানোরের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সম্প্রতি তানোর উপজেলার ওই তিন পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, এবার বৃষ্টি বেশি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকের এই পানির মাধ্যমে আমন ধানের চাষ করছেন। চাষি রানা চৌধুরী বলেন, তানোরে কোথাও নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। যে জায়গায় এখনো গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায়, সেখান থেকে খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হয়।

গোদাগাড়ীতে পানির স্তর উঠছে
এবার গোদাগাড়ী উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে ওপরে উঠেছে। উপজেলা সদরে গত বছর পানির স্তর ছিল মাটির ২৬ ফুট ৪ ইঞ্চি নিচে, এবার তা উঠে এসেছে ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চিতে। আমতলী-১ পয়েন্টে গত বছর পানির স্তর ছিল ৮৬ ফুট নিচে, এবার তা উঠে দাঁড়িয়েছে ৮৩ ফুট ৮ ইঞ্চিতে। আর পরমানন্দপুর-১–এ গত বছর পানির স্তর ছিল ৭৭ ফুট ১১ ইঞ্চি নিচে, এবার তা উঠে এসেছে ৭৩ ফুট ৮ ইঞ্চিতে। 

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ভাজনপুর গ্রামে চলতি আমন মৌসুমে ধান রোপণের দৃশ্য। সম্প্রতি তোলা 

প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হওয়ায় গোদাগাড়ীতে এবার পানির স্তর ওপরে উঠেছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, বৃষ্টি কমলে গোদাগাড়ীর পানির স্তরের আসল চিত্র বোঝা যাবে। এ বিষয়ে বিএমডিএর গোদাগাড়ী উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী আবদুল লতিফ জানান, তাঁরা যে তিনটি কূপে পানি পরিমাপ করেন, সব কটিতেই পানির স্তর ওপরে উঠে এসেছে। এমনটি গত ১৯ বছর হয়নি।

রাজশাহীর এসব এলাকায় পানি সুশাসন নিয়ে গবেষণা করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজ্জাকুল ইসলাম। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তানোরের ভূমির গঠন একটু ভিন্ন। এখানকার ভূমি ঢালু। পানি দাঁড়াতে পারে না। ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত মাটির নিচে মিহি কাদার স্তর আছে। পানি নামতে সময় লাগে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং পরের বছর পুনর্ভরণ না হওয়ার কারণে অ্যাকুইফার মারা গিয়েও এমন হতে পারে।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন