[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

নদী জরিপ হয়নি ৫৫ বছর, কত নৌযান চলাচল করছে জানা নেই

প্রকাশঃ
অ+ অ-

রাজধানীর সদরঘাট টার্মিনাল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে ঠিক কতগুলো এবং কত ধরনের নৌযান চলাচল করে, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। শুধু যেসব নৌযান নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিবন্ধিত হয়েছে, সেগুলোই নথিভুক্ত। এর বাইরে ছোট-বড় নানা ধরনের নৌযান প্রতিদিন নদীতে চলাচল করলেও তার কোনো তথ্য নেই অধিদপ্তরের কাছে। ফলে নিবন্ধনের বাইরে অবৈধভাবে চলা এসব নৌযান থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পায় না।

নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নৌযানের সঠিক সংখ্যা জানতে হলে নৌযান জরিপ বা নৌশুমারি করা প্রয়োজন। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো নৌযান জরিপ হয়নি। ফলে দেশের নৌপথে কত ধরনের কতসংখ্যক নৌযান চলাচল করছে, তার সঠিক চিত্র জানা সম্ভব নয়।

অধিদপ্তরের প্রধান নৌ জরিপ কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মো. গিয়াসউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অভ্যন্তরীণ নৌযানের কোনো হিসাব নেই। তবে যেগুলো বিদেশগামী, সেগুলোর হিসাব আমাদের কাছে আছে। অভ্যন্তরীণ নৌযানের ডেটাবেইস তৈরির কাজ চলছে, খুব শিগগিরই তা হয়ে যাবে।’

তবে বৈধ উপায়ে নৌযান চালাতে হলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধনের সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। অধিদপ্তর নৌযান সার্ভে করে সবকিছু ঠিক আছে কি না যাচাই করার পর নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেয়। অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ২২ ধরনের নৌযান নিবন্ধিত রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে দেশের বিভিন্ন নৌপথে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের অসংখ্য নৌযান নিয়মিত চলাচল করলেও তার কোনো তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।

অনিবন্ধিত নৌযান বন্ধে কার্যকর নজরদারি বা মনিটরিং কম। ফলে ফিটনেসবিহীন ও জোড়াতালির নৌযান অবাধে চলাচল করছে। এতে নৌযান ও নৌপথের নিরাপত্তা যে ঘাটতির মধ্যে রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এমন বাস্তবতায় আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নৌ দিবস পালন করছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২০ হাজার ৫৫২টি নৌযান নিবন্ধন করা হয়েছে। নিবন্ধিত ২২ প্রকার নৌযানের মধ্যে রয়েছে—যাত্রীবাহী লঞ্চ ৮৫৩টি, যাত্রীবাহী বোট ৭০০টি, মালবাহী ৩ হাজার ৮৩৮টি, তেলবাহী ৪২৫টি, বালুবাহী ৭ হাজার ৯৩৩টি, ড্রেজার ২ হাজার ২০২টি, কাটার সাকসন ড্রেজার ৬৯টি, পণ্যবাহী ১ হাজার ৯০৯টি, ট্যাগ বোট ২১৮টি, স্পিড বোট ১ হাজার ২৮১টি, ফেরি ৫০টি, ওয়ার্ক বোট ১৭১টি, পরিদর্শন বোট ৩৩টি, ট্যুরিস্ট লঞ্চ ৩২টি, বার্জ ৬৪৬টি, হাউস বোট ২০টি, ওয়াটার ট্যাক্সি ১৬টি, ফ্লোটিং পাম্প ৩১টি, পন্টুন ১৫টি, ক্রেন বোট ৩২টি, ট্যুরিস্ট বোট ৭টি, ফ্লোটিং হাসপাতাল ৭টি এবং অন্যান্য ৬৪টি নৌযান।

দেশে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে মোট নৌযানের সংখ্যা নির্ধারণে ২০১৬ সালে নৌযান শুমারি প্রকল্প নেওয়া হলেও দীর্ঘদিনেও তার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন পায়নি। প্রায় আট বছর ঝুলে থাকার পর প্রকল্পটি ২০২৫ সালের এপ্রিলে একনেকে অনুমোদন পায়।

প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত এবং ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। এর আওতায় একটি জাতীয় নৌযান ডেটাবেইস তৈরি হবে, যেখানে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত নৌযান আলাদা করা যাবে। অনিবন্ধিত নৌযানগুলো নিবন্ধনের আওতায় এনে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করা হবে।

জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মো. শফিউল বারী বলেন, ‘নৌযানের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে ডেটাবেইস তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে এমওইউ সই হয়েছে। বিবিএস কাজও শুরু করেছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রতিটি নৌযানের তথ্য ডেটাবেইসে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেখানে নৌযানের নাম, নিবন্ধন, ইঞ্জিনের বৈশিষ্ট্য, কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশদূষণের মাত্রা—সবকিছুই থাকবে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ হাজার নৌযান নিবন্ধনবিহীনভাবে চলাচল করছে। ডেটাবেইস তৈরি হলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধ হবে।’

নৌ-সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাত সম্ভাবনাময় হলেও নানা ঘাটতি রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা নদীর নাব্যতা সংকট। পর্যাপ্ত ড্রেজিং (পুনঃখনন) না হওয়ায় অনেক জায়গায় নৌযান চলাচল ব্যাহত হয়। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আধুনিক ঘাট ও টার্মিনালের অভাব, পুরোনো যাত্রীবাহী ও মালবাহী নৌযান, নিরাপত্তা সরঞ্জামের ঘাটতি—সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।

এ ছাড়া নীতি প্রণয়নে সমন্বয়ের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ধীরগতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যাওয়া, নদী দখল ও দূষণও নৌপথ সংকুচিত করছে। যাত্রীসেবার সীমাবদ্ধতা ও আধুনিকায়নে ধীরগতি নৌপরিবহন খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমরান উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশে নৌপরিবহন খাতে অপার সম্ভাবনা থাকলেও নানা ঘাটতি রয়েছে। নানা সমস্যা আমাদের নৌপরিবহন খাতকে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে দিচ্ছে। সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া সরকারের পক্ষে কার্যকর নীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। তাই জরুরি ভিত্তিতে নৌশুমারি করা, অনিবন্ধিত নৌযান নিয়ন্ত্রণ, ড্রেজিং বাড়ানো এবং আধুনিকায়নে জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া নৌপরিবহন খাতে সরকারের বাজেট নিতান্তই অপ্রতুল। বাজেট বাড়িয়ে সঠিক পরিকল্পনা করে সড়কপথের ওপর চাপ কমিয়ে নৌপথে টেকসই উপায়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করা করা সম্ভব।’

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন