নদীভাঙনের করাল গ্রাসে উপকূলীয় মানুষের দুঃসহ জীবন
![]() |
কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ঝুপড়ির পাশে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
কপোতাক্ষ নদে পূর্ণ জোয়ার। খুলনার কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ঝুপড়ির পাশে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি কেওড়াগাছ। অথচ একসময় সেখানে ছিল বিভিন্ন গাছের ঘন সবুজ প্রাচীর। কয়েক মাসের ব্যবধানে সব গাছ উধাও হয়ে এখন শুধু কেওড়াগাছটি ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওইগুলান শুধু গাছ ছিল না, আমাগের পাহারাদার ছিল। নদীর ভাঙন ঠেকাইত। সুন্দরবন থেইকে ফল আনি চারা লাগাইছিলাম। বাড়ির সামনে তিন হাজারের বেশি গাছ হইছিল। কিন্তু বাঁধ বানানোর মাটি নেবার কথা কইয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সব উপড়ে দিছে। এখন ঢেউ এক্কেবারে বাড়ির ওপর আইসে পড়ে। এই ঘরডা ভাঙলি আর মাথা গোঁজার জাগা থাকপে না।’
কপোতাক্ষের ভাঙনে বহুবার বসতভিটা হারিয়েছেন চরামুখার মানুষ। দেলোয়ারও এর ব্যতিক্রম নন। কয়েক দফা ঘর সরিয়ে বাঁধের কাছে আসতে হয়েছে তাঁকে। শেষ পর্যন্ত অনিরাপদ চরে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, পাউবো যন্ত্র দিয়ে তাদের জমির গাছ উপড়ে মাটি কেটে নিয়েছে। ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু এখনো তিনি পাননি।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, কয়রার দক্ষিণ ও উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরে ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চলছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা পাউবো যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা।
তবে স্থানীয় মানুষেদের অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণ না করেই ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘর, জমি আর গাছ হারিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আগেই উচ্ছেদ এবং আদৌ ক্ষতিপূরণ মিলবে কি না—এ শঙ্কা তাঁদের ঘিরে আছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার এক পাশে পাশে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী, অন্য পাশে কপোতাক্ষ নদ। দুই নদীর তীরে মাটি ফেলে বেড়িবাঁধ তৈরির কাজ চলছে। কিছু স্থানে মাটির কাজ শেষ, আবার কিছু স্থানে বালুর বস্তা ফেলার অপেক্ষায় রয়েছে। কয়েকটি স্থানে সিসি ব্লক নির্মাণও চলছে। বেড়িবাঁধের পাশে বসবাসকারী অনেক পরিবার ইতিমধ্যেই তাদের ঘর ভেঙে ফেলছে, কিন্তু জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
উত্তর বেদকাশীর বাসিন্দা গণেশ, ইদ্রিস, সোমেন, সাবিত্রীসহ অনেকে বলেন, কোনো নোটিশ ছাড়াই তাঁদের জমির ওপর দিয়ে বাঁধ তোলা হচ্ছে। অন্য কোথাও তাঁদের জমি নেই। তাঁরা কোথায় যাবেন, এখনো ভাবেননি।
দক্ষিণ বেদকাশীর আবুল কালাম গাজী বলেন, ‘৩২ বছর ধইরে শাকবাড়িয়া নদীর পাশের বিলি ১৫ কাঠা জমি কিনি বাস করতিছি। এখন সেই জমির ওপর বেড়িবাঁধ হতিছে। অন্য কোনো জাগায় আমাগের জমি নেই। ঘর ভাঙার পর কনে যাব, কী করব, তা–ও জানিনে।’
চরামুখার কর্ণধর মণ্ডল বলেন, ‘বিনা অধিগ্রহণে যন্ত্র দিয়ে মাটি আর গাছ কাইটে বাঁধ বানানি হচ্ছে। আমরা এলাকার মানুষ সংবাদ সম্মেলন আর লিখিত অভিযোগ দিছিলাম, তাতেও কোনো সুরাহা হয়নি।’ ষাটোর্ধ্ব সামাদ সানা বলেন, ‘৩০ বছর আগে সুন্দরবনের আয় দিয়ে জমি কিনিলাম। নতুন বাঁধের জন্যি জমি, গাছ, মাটি, সব শেষ। কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। এখন শুধু নদীতে ভাইসে যাওয়া বাকি।’
অধিগ্রহণের আগেই কাজ শুরু কেন—জানতে চাইলে খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, এই প্রকল্পের জন্য ৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় কাজ দ্রুত শুরু করা হয়েছে। না হলে বেড়িবাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হতে পারত।
দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার আকবর আলী ও আসলাম চৌধুরী জানান, নদীর চরে কেওড়া, বাইন, গেওয়াসহ নানা ধরনের লক্ষাধিক গাছের বাগান ছিল, যা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকাত। নতুন বাঁধ প্রকল্পে মেশিন দিয়ে সব গাছ উপড়ে দেওয়ায় আর কোনো সুরক্ষা নেই। বরাদ্দ থাকলেও বিনা খরচে মাটি নিয়েছে পাউবো। ক্ষতিপূরণ বা অধিগ্রহণ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি, উল্টো বাধা দিলে মামলার ভয় দেখানো হয়।
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে উপসহকারী প্রকৌশলী মমিনুল হক বলেন, ভবিষ্যতে আর চরের মাটি নেওয়া হবে না, স্থানীয় এলাকা থেকে মাটি কেনা হবে। গাছ কাটার দায় পাউবোর নয়। এক্সকাভেটর নামানোর পর স্থানীয় কিছু বাসিন্দাই গাছ কেটে নিয়েছে।
পাউবোর সাতক্ষীরা-২ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম বলেন, জমি অধিগ্রহণের জন্য সার্ভে ও ম্যাপিং শেষ হয়েছে। প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন মিললে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন