রাজশাহীতে জুলাই আন্দোলনে হামলার মামলাকে ‘বাণিজ্যিক মামলা’ করার অভিযোগ
![]() |
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টির রাজশাহী মহানগরের নেতারা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহীতে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৭টি মামলা হয়েছে। ঘটনার সাড়ে ১৩ মাস পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অভিযোগে আরও একটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি আসামিদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও জনপ্রিয় কোচিং সেন্টারের মালিক। আসামিদের এমন তালিকা নিয়ে শহরে নানা সমালোচনা চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, মামলা-বাণিজ্য করতেই বিত্তবানদের বেছে বেছে আসামি করা হয়েছে। মামলার নেপথ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজশাহীর নেতাদের মদদ রয়েছে, এমন আলোচনাও ছড়িয়েছে। তবে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এনসিপির মহানগরের নেতারা। তাঁরা বলছেন, কেউ কেউ এই মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার নামে অর্থ দাবি করছেন বলে তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন। এই মামলাটিকে বাণিজ্যিক মামলা হিসেবে ব্যবহার করারও অভিযোগ এসেছে। তবে এর সঙ্গে এনসিপির নেতারা জড়িত নন।
মামলাটির বাদীর নাম কৌশিক ইসলাম ওরফে অপূর্ব। তাঁর বাড়ি নগরের শিরোইল কলোনি এলাকায়। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজশাহী নগরের আলুপট্টি মোড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে তিনি আহত হয়েছিলেন। এর ১৩ মাস ১৫ দিন পর ২০ সেপ্টেম্বর চুরি, হুমকি, মারধর ও বিস্ফোরক আইনে নগরের বোয়ালিয়া থানায় তিনি মামলা করেছেন। মামলায় ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে তাঁদের আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বেছে বেছে ‘পয়সাওয়ালা’ বা চাকরিজীবী; যাঁদের মামলার ভয় দেখিয়ে বেকায়দায় ফেলা যায়, এমন লোকদেরই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই মামলার আগে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছে। তাঁদের মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। এমন অভিযোগ পেয়েছে এনসিপির মহানগরের নেতারাও।
এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ মামলার ১২৯ নম্বর আসামি তামান্না ইয়াসমিন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একজন অফিস সহকারী। এজাহারে তাঁকে আওয়ামী লীগের অর্থদাতা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাদের সঙ্গে আরও আছেন সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মাহাতাব চৌধুরী, ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী এনায়েতুর রহমান, হোটেল ডালাসের মালিক ডলার, খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার সমিতির নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হামিদুল আলম।
চাকরিজীবীদের মধ্যে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা; মসজিদ মিশন স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান খান; রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ নওশাদ আলী ও তবিবুর রহমান শেখ; রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের কর্মচারী সংসদের সভাপতি তৌফিক; রাকাবের কর্মচারী হাসিবুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন ও আমিনুল ইসলাম; রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আজমির আহমেদ মামুন; সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা কৌশিক দত্ত, ফররুখ আহমেদ, রতন আলী, কামাল পারভেজ, এ বি এম আসাদুজ্জামান, নাদিম নাহিয়ান, নাজমা ইসলাম, অমিত রানী শান্তা, রাজু আহমেদ, পাপড়ি খাতুন ও রেজওয়ানুল হুদা; রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজিব কোরাইশ; রেলের কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, সাবির উদ্দিন, মোহাম্মদ ফরহাদ মজুমদার, তাহেরুল ইসলাম, জান্নাতুন ঝিলিক, আকতার আলী ও ইকবাল হোসেন; রাজশাহী ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানা ডন ও তাঁর স্ত্রী সায়েরা বানু এবং এনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক সারওয়ার জাহান।
রাজনীতি না করলেও মামলায় জনপ্রিয় কয়েকটি কোচিং সেন্টারের মালিককেও আসামি করা হয়েছে। তাঁরা হলেন জুয়েল কেমিস্ট্রির পরিচালক আসাদুজ্জামান জুয়েল, জাহিদ ফিজিকসের পরিচালক জাহিদ হাসান, দেবাশীষ ফিজিকসের পরিচালক দেবাশীষ, চঞ্চল ফিজিকসের পরিচালক আবদুল ওহাব চঞ্চল ও উজ্জ্বল ম্যাথ ক্লাবের উজ্জ্বল হোসেন।
ঘটনা মহানগরের হলেও গ্রামের অনেক জনপ্রতিনিধিও মামলায় আসামি হয়েছেন। তাঁরা ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন, মাটিকাটা ইউপির চেয়ারম্যান সোহেল রানা, কাঁকনহাটের সাবেক মেয়র আবদুল মজিদ, কাটাখালী পৌরসভার সাবেক নারী কাউন্সিলর আয়েশা বেগম, তানোরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশীদ ময়না ও সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সোনিয়া সরদার। ওই দিন ঘটনাস্থলে তাঁদের দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
এ মামলায় আসামি হয়েছেন, এমন একজন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এর আগেও তাঁকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছিল। অথচ তিনি কোনো রাজনীতি করেন না। চাকরি রক্ষায় তিনি ওই মিথ্যা মামলার বাদীর সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন। মোটা টাকার বিনিময়ে বাদী তাঁকে অ্যাফিডেভিট করে দেন যে ভুল করে এজাহারে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল। এই মামলাতেও একই কারণে টাকাওয়ালা ব্যক্তিদের বেছে বেছে আসামি করা হয়েছে বলে তাঁর ধারণা। তবে এবার তিনি আর টাকা দিয়ে অ্যাফিডেভিট করে নিতে চান না।
এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাননি মামলাটির তদন্ত করছেন বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শরিফুল ইসলাম। মামলার বাদী কৌশিক ইসলাম অপূর্বের মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। মামলা সাক্ষীদের ফোন নম্বর না থাকার কারণে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে এনসিপির মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী মোবাশ্বের আলী আজ বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি গতকাল বুধবার রাতে ফেসবুকে দেওয়ার তাঁর একটি স্ট্যাটাসও পড়ে শোনান।
মামলার বাদী তাঁদের সুপরিচিত উল্লেখ করে মোবাশ্বের আলী লিখেছেন, ‘রাজশাহীতে ১৩৫ জনকে আসামি করে জুলাই আহত অপূর্ব নামের এক ছেলে গত কয়েক দিন আগে বোয়ালিয়া থানায় একটা মামলা করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই মামলা জাতীয় নাগরিক পার্টি, রাজশাহীর পক্ষ থেকে হয়েছে বলে সব মহলে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি খুব স্ট্রংলি (শক্তভাবে) ঘোষণা করছি, আমরা পার্টির কেউ এই মামলার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নই। আমরা মামলাটির পর জেনেছি এবং এই মামলা নিয়ে বিভিন্নভাবে নানান ফোন পাচ্ছি। কেউ কেউ এই মামলা নিয়ে আসামিদেরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নামে বড় ফিগারের অর্থ দাবি করছে শুনতে পাচ্ছি। এই মামলাকে বাণিজ্যিক মামলা হিসেবে ব্যবহার করারও অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে।’
মোবাশ্বের আলী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা রাজশাহী মহানগর এনসিপি দ্ব্যর্থহীনভাবে এসব নোংরামিকে প্রত্যাখান করছি। রাজশাহী মহানগর ও রাজশাহী জেলার কোনো নেতা কারও কাছে এই মামলা নিয়ে অর্থ লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে রাজশাহী সংগঠন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
মোবাশ্বের আলী বলেন, এই মামলায় কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে যদি সত্যি সত্যিই জড়ানো হয়ে থাকে, যাঁরা জুলাইয়ে রাজশাহীতে সন্ত্রাসী আওয়ামী বাহিনীর সঙ্গে মাঠে-ময়দানে ছিল না এবং নেপথ্যেও তাঁদের সহযোগিতার কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই, এ রকম যাঁরা আছেন, তাঁরা যোগাযোগ করলে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়াবেন। মামলা করার পর বাদীও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। এমন যদি হয়, তাহলে নিরাপত্তার প্রয়োজনে তাঁরা তাঁর পাশেও থাকবেন।
একই প্রেক্ষাপটে ২৭টি মামলার পর কেন আরও একটি মামলা করতে হলো, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোবাশ্বের আলী বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে এখন যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলো একটি কমিটি দেখেশুনে করছে। সেই কমিটির প্রধান হচ্ছে পুলিশ কমিশনার। হয়তো তাঁরা গবেষণা করেই মামলা করেছেন। এ ছাড়া তিনি বলেন, ফ্যাক্ট চেকিং করে মামলা করতে বাদী হয়তো সময় নিয়েছেন। বাদী জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি। চিকিৎসার প্রয়োজনেও তাঁর দেরি হতে পারে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অভ্যুত্থানের অনেক দিন পার হয়ে যাওয়ায় এখন ওই ঘটনায় কেউ মামলা করতে চাইলে নির্ধারিত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যার আহ্বায়ক রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার। কমিটির অনুমোদনের পর মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মামলাটি কমিটি অনুমোদন করেছে। এমনকি পিপি (সরকারি কৌঁসুলি) সাহেবও দেখেছেন। অনেক দিন থেকেই তাঁরা এই মামলা রেকর্ড করার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কমিটি অনেক কিছু সংশোধন করেছে। তারপরও কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে। এগুলো আমরা তদন্ত করে দেখব।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন