[tenolentSC] / results=[3] / label=[ছবি] / type=[headermagazine]

গুজবে ভরছে সচিবালয়

প্রকাশঃ
অ+ অ-

বাংলাদেশ সচিবালয় | ফাইল ছবি

‘ড. ইউনূস দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।’
‘পুরো উপদেষ্টা পরিষদে পরিবর্তন আনবেন ড. ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে নানা কারণে তিনি এখন ত্যক্ত-বিরক্ত।’
‘ছয় শর্ত মেনে নিলে ডিসেম্বরেই পুরো কেবিনেট নিয়ে সরে দাঁড়াবেন ড. ইউনূস।’
‘ড. ইউনূস চলে গেলে আসবে নতুন কেয়ারটেকার সরকার।’
‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে না। হলেও তা হবে গণভোট।’
‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।’
‘অক্টোবরে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তিনি এলেই দেশের রাজনৈতিক চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে।’

পাড়ার চায়ের দোকান, বাজার, অফিসের আড্ডা থেকে শুরু করে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সব জায়গায়ই এ ধরনের আলোচনা চলছে। কিন্তু এগুলো কতটা সত্য? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসবের কোনো ভিত্তি নেই; সবই নিছক গুজব। 

তবে শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, এসব গুজব ঘুরছে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেও। নেই কোনো প্রমাণ, নেই নির্ভরযোগ্য সূত্র—তবুও এসব নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এর প্রভাব পড়েছে আমলাদের আচরণেও।

সচিবালয় ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে যেখানে সর্বত্রই ড. ইউনূসের প্রশংসা শোনা যেত, এখন সেখানে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হচ্ছে। প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে ড. ইউনূসের সততা নিয়েও। উপদেষ্টাদের নিয়েও চলছে প্রবল সমালোচনা।

উপদেষ্টাদের কাজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, এমনকি সততা নিয়েও এখন আলোচনা হচ্ছে সচিবালয়ে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়া অনেক কর্মকর্তাকে নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে—যা দুই মাস আগেও ছিল বিরল।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন সচিবকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। বলা হচ্ছে, এভাবেই হয়তো একদিন কেবিনেট সচিবকেও সরিয়ে দেওয়া হতে পারে! অথচ কয়েক মাস আগেও এসব কর্মকর্তার নামে সচিবালয়ে বন্দনা শোনা যেত।

জানা গেছে, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চাকরিতে ফেরা—এসব বিষয় নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা চলছে। সমালোচকদের দাবি, এদের মধ্যে অনেকে এসব সুবিধার যোগ্য নন। কেউ অসৎ, কেউবা সরকারকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন—এমন অভিযোগও ভাসছে বাতাসে।

এছাড়া গুঞ্জন রয়েছে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করা কিছু আমলা এখন ভিন্ন সুর ধরেছেন। কিছুদিন আগেও যারা তারেক রহমানকে দেশের ভবিষ্যৎ শাসক বলতেন, তারাই এখন ‘সৎ মানুষের শাসনের’ কথা বলে নতুন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। শুধু তাই নয়, অনেকে একক দলের সরকার নয়—বরং সব মতের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের পক্ষে কথা বলছেন।

আমলাদের এই হঠাৎ খোলস বদলে ফেলা অনেককে অবাক করেছে। কথিত আছে, দীর্ঘদিনের বিরতির পর সচিবালয়ের ভেতরে জামায়াতপন্থি কর্মচারীদের সংগঠন আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দাবিতে তারা নানান ইস্যুতে আন্দোলনও শুরু করেছে।

আরও জানা গেছে, শুরুর দিকে তেমন সমস্যা না থাকলেও কিছুদিন পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো মেয়াদে প্রশাসনের সর্বত্র এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। স্তরে স্তরে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। নতুন পে-স্কেল, পদোন্নতি, ক্যাডার বৈষম্য, মহার্ঘ ভাতার দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সচিবালয়ের কর্মচারীরা সরব রয়েছেন। এর মধ্যেই চলছে বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করার কার্যক্রম।

নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কাজে সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে। অন্যের কপালে ‘ফ্যাসিবাদের তকমা’ লাগিয়ে নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থানে নেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ উপস্থাপনের নীরব প্রতিযোগিতাও দেখা যাচ্ছে।

এসব নানা কারণে প্রশাসনের ভেতরে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে সরকারি কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। গুঞ্জন রয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থক আমলারা এ অবস্থার জন্য বেশি দায়ী।

এমন প্রেক্ষাপটে শোনা যাচ্ছে, আমলাতন্ত্রের কাছে অন্তর্বর্তী সরকার একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে, এই পরিস্থিতি সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ড. ইউনূস যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন দেশের মানুষ তাঁর ওপর আস্থা প্রকাশ করেছিলেন। তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই আস্থার মূল্য দিতে হলে তাঁকে শক্ত হতে হবে। অসহযোগী আমলাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, উপদেষ্টা পরিষদকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল করতে হবে, প্রয়োজনে কাউকে বাদ দিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে।

কিন্তু এখন সেই মানুষজনই বলছেন, ড. ইউনূসের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আর নেই। তিনি দেশের মানুষের কথা নয়, নিজের স্বপ্ন নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেই তিনি সময় দিচ্ছেন। তাই দ্রুত নির্বাচন দিয়ে তাঁর সরে যাওয়া উচিত বলেও মত দিচ্ছেন অনেকে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, 'ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে হাতাহাতির ঘটনা আমার চাকরি জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি। অথচ এই সরকারের আমলে তা দেখলাম। হাতাহাতিতে জড়িত সেই মাস্তান ডিসিরাই এখন জেলা সামলাচ্ছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের আলাপচারিতার রেকর্ড প্রকাশ হতে আগে কখনও শুনিনি, এই আমলেই তা শুনলাম।' 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন,'আসলে এই সরকার যে এতটা অথর্ব হয়ে পড়বে, তা আমরা কল্পনাও করিনি। হবেই বা না কেন? রাষ্ট্রের কঠিন সময়ে প্রধান উপদেষ্টাকে যথাযথ বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার মতো উপদেষ্টা পরিষদে কয়জন আছেন?' 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'ক্ষমতা পাওয়ার আগেই যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করে, দেশজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, চাঁদাবাজ দলের পরিচিতি লাভ করে—তাদের দিয়ে দেশ ভালো চলবে না। দেশের মানুষও নিরাপদ নয়। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সৎ মানুষের শাসন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।' 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন,'আমলাদের কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া উচিত নয়। তারা জনগণের সেবক, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন হয়। বর্তমান সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা দেশ গঠনের একটি সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে।' 

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন