দেবীর জাগরণে ভরে উঠছে মন্দির–মণ্ডপ, অপেক্ষা মহাউৎসবের
![]() |
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজার বোধন উৎসবে দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজার মুহূর্ত। আজ শনিবার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের উপদেষ্টা পুরোহিত প্রণব চক্রবর্তী বলেন, 'বোধন মানে ‘জাগরণ’, ঘুম থেকে দেবীকে জাগিয়ে তোলা। ষষ্ঠী তিথিতে আমরা দেবীর পূজার আমন্ত্রণ জানাই। মূল পূজা সাধারণত সপ্তমী থেকে শুরু হয়।'
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, প্রতি শরতে দশভূজা দেবী দুর্গা ‘কন্যারূপে’ মর্ত্যলোকে বাবার বাড়িতে আসেন। তাঁর আগমন থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন দুর্গোৎসব চলে। মহালয়া দিয়ে শুরু হওয়া উৎসবের প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা এবছর ২১ সেপ্টেম্বর সম্পন্ন হয়েছে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দেবী গজে অর্থাৎ হাতির পিঠে চড়ে আগমন করবেন। গজে আগমন শস্য শ্যামলা হওয়ার প্রতীক। আর দশমীতে তিনি দোলায় চড়ে মর্ত্যলোক ত্যাগ করবেন। এসময় দোলায় দেবীর গমনকে মহামারী বা দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ‘বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ’ ও ‘মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি’ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঢাকায় এবার মোট ২৫৯টি মণ্ডপে পূজা হবে, যা গতবারের তুলনায় সাতটি বেশি। সারাদেশে মণ্ডপের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি, যা প্রায় এক হাজার বেশি।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, 'আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে ঈদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, ভয়ের ছায়া বা পুলিশি পাহারার ব্যতিরেকে পালন করা সম্ভব হবে।'
দুর্গাপূজায় বিভিন্ন স্থানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট জানিয়েছে, সারাদেশে সাত শতাধিক পূজামণ্ডপকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে নাগরিক সমাজের নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’ বলছে, ২৯ জেলা এ বছরকে তারা ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে দেখছে।
র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সহিংসতা বা নাশকতা ঠেকাতে এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ঢাকায় ৯৪টি টহল দল ও সারাদেশে ২৮১টি টহল মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে বিজিবি জানিয়েছে, পূজার নিরাপত্তায় সীমান্তবর্তী অঞ্চলসহ সারাদেশে তাদের ৪৩০ প্লাটুন সদস্য নিয়োজিত থাকবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ২৪টি বেইজ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সারাদেশের ২ হাজার ৮৫৭টি পূজামণ্ডপের মধ্যে সীমান্তের আট কিলোমিটারের ভেতরে রয়েছে ১ হাজার ৪১১টি, পার্বত্য এলাকায় রয়েছে ১৫টি এবং বাকি ১ হাজার ৪৪৬টি মণ্ডপ সীমান্তের বাইরে।
রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ৪৪১টি মণ্ডপ; চট্টগ্রাম নগর, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯৪টি; আর দেশের অন্য জায়গায় রয়েছে ৩১১টি মণ্ডপ।
বিজিবি আরও জানিয়েছে, পূজা চলাকালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় বিশেষ টহলও চলছে।
প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এক বার্তায় তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মমতে দেবী দুর্গা জগতের মঙ্গল কামনায় স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আসেন। ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে অশুভ শক্তির বিনাশ ও সৃষ্টির লালন করেন তিনি। এই আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবকে দিয়েছে অনন্য তাৎপর্য।
ইউনূস বলেন, 'সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের অপূর্ব মেলবন্ধনের উদাহরণ বাংলাদেশ। জাতি–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ধারাকে সমুন্নত রেখে এবারের দুর্গাপূজাও সারাদেশে নির্বিঘ্নে, উৎসাহ–উদ্দীপনা ও নানা আয়োজনে পালিত হবে বলে আমি আশা করি।'
তিনি আরও বলেন, শান্তি, মৈত্রী ও সাম্য সব ধর্মেরই মূল শিক্ষা। তাই মানুষের কল্যাণ সাধনের পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা বজায় রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা মনে করিয়ে দেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যাত্রা শুরু হয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
বার্তার শেষে তিনি বলেন, 'সকল অশুভ, অন্যায় আর অন্ধকারকে পরাজিত করে শুভ চেতনার জয় হবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে—দুর্গাপূজা উপলক্ষে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।'
উৎসবের ৫ দিন
এবারও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে কেন্দ্রীয়ভাবে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেছে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন নানা ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান হবে।
রোববার সকালে ষষ্ঠ্যাদি, কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজার মধ্য দিয়ে পূজা শুরু হবে। এদিন দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসও অনুষ্ঠিত হবে।
সোমবার মহাসপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন ও পূজা হবে। ‘নবপত্রিকা’ বলতে নয়টি গাছের পাতা বোঝায়—কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান। এগুলোকে একটি কলাগাছে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি পরানো হয়। বধূসদৃশ এই প্রতীককে ‘কলাবউ’ বলা হয়। প্রচলিত বিশ্বাসে, নবপত্রিকা দুর্গার নয় রূপের প্রতীক।
নবপত্রিকা প্রবেশের পর দেবীকে দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার মাধ্যমে মহাস্নান করানো হবে।
মঙ্গলবার মহাষ্টমীর দিনে হবে মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ ও পূজা। দুপুর ১টা ৫০ মিনিট থেকে ২টা ৩৮ মিনিট পর্যন্ত হবে সন্ধিপূজা। এর আগে ও পরে ভক্তদের জন্য মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হবে।
এছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনে প্রতিবছরের মতো এবারও ‘কুমারী পূজা’সহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হবে।
শারদীয় দুর্গোৎসবের সবচেয়ে বড় আয়োজনগুলোর মধ্যে মহাঅষ্টমীর কুমারী পূজা এবারও অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সেখানে ফুল, জল, বেলপাতা, ধূপ-দীপসহ ষোড়শ উপচারে কুমারীরূপে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হবে।
বুধবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হবে মহানবমীর কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। সকালে তর্পণ শেষে দেবীর মহাস্নান, পরে ষোড়শ উপচারে পূজা ও অর্ঘ্য নিবেদন করা হবে। ভক্তরা দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করবেন। সন্ধ্যায় হবে আরতি প্রতিযোগিতা। অনেক মণ্ডপে নবমীতে যজ্ঞও অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন থেকেই ভক্তদের মনে বিদায়ের সুর বাজতে শুরু করে।
বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীতে সকালে হবে দশমীর বিহিত পূজা, এরপর দর্পণ বিসর্জন। দুপুরে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি এবং বিকেল ৩টায় বের হবে বিজয়া শোভাযাত্রা।
বিজয়া দশমীতে একদিকে আনন্দময়ী মাকে বিদায় জানানোর ব্যথা, অন্যদিকে পরের বছর তাঁর আগমনের অপেক্ষা। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন