গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পরাজয়, এনসিপিতে নানা প্রতিক্রিয়া
ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের নেতারা | ফাইল ছবি |
ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলকে সমর্থন দিয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে ভোটে এই প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। এ নিয়ে এনসিপির ভেতরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ডাকসুতে বিপর্যয়ের জন্য দলটির নেতারা একে অন্যকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন।
এনসিপি তারুণ্যনির্ভর দল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের অবস্থান বা গ্রহণযোগ্যতা এখন কেমন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে তা অনেকেই বুঝতে চাইবেন—এমন ধারণা দলটির নেতাদের মধ্যেও ছিল। সে কারণে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে দলটির নেতাদের নানামুখী তৎপরতা ছিল। কিন্তু ভোটে এর প্রতিফলন কতটা ঘটল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা ডাকসুর ২৮টি পদের একটিতেও জিততে পারেননি।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদকে অনেকে এনসিপির ছাত্রসংগঠন মনে করে থাকেন। ডাকসু নির্বাচনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে আলোচনায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। আর জিএস প্রার্থী ছিলেন সম্মুখসারির আরেক সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। ডাকসু নির্বাচন করবেন বলেই তাঁরা দুজন এনসিপিতে যোগ দেননি, এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে রয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত এক বছর ক্যাম্পাসে নানা ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছেন। তাঁদের প্যানেলের অন্য প্রার্থীদেরও অনেকে ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা ডাকসুর ২৮টি পদের একটিতেও জিততে পারেননি। ভিপি পদে মাত্র ১ হাজার ১০৩ ভোট পেয়েছেন কাদের আর জিএস পদে বাকের পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১ ভোট। ভোটের হিসাবে দুজনই হয়েছেন পঞ্চম। আর চারটি সম্পাদকীয় পদে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা দ্বিতীয় হয়েছেন, তবে অন্যগুলোতে তাঁরা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তৈরি করতে পারেননি।
ডাকসুতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের এই বিপর্যয় জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন দলটির অনেক নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী ডাকসু নির্বাচনের আগে দলের একজন শীর্ষ নেতাকে জানিয়েছিলেন, নির্বাচন প্রভাবিত করতে একটি বিশেষ দলের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চলছে। কিছু সুনির্দিষ্ট ঘটনার কথাও তিনি ওই নেতাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই নেতা নির্বাচনে বিশেষ দলের প্রভাব ঠেকাতে ন্যূনতম কোনো চেষ্টাও করেননি।
ডাকসুতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের এই বিপর্যয় জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপির ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন দলটির অনেক নেতা। ডাকসুর ফলাফল দেখার পর ক্ষুব্ধ হয়ে একজন নেতা ইতিমধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
জুলাইয়ের সব অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই পরিচয় লুকিয়ে আমাদের মধ্যে ঢুকেছেন। ফলে আমাদের সংগঠন শক্তিশালী হয়নি। আমাদের ভেতর থেকে অনেকেই বিভাজন তৈরি করেছেন, যা দৃশ্যমানও হয়েছে। সংগঠন শক্তিশালী করতে না পারায় আমাদের বিভাজনগুলো প্রকাশ্য হয়েছে। সংগঠিতভাবে কাজ করতে না পারাও আমাদের বড় ব্যর্থতা।
— আবু বাকের মজুমদার, ডাকসুতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাঁদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য কেউ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিষয়টি এমন নয়। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ নবীন ছাত্রসংগঠন। অল্প সময়ে তারা সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনে এর প্রভাব দেখা গেছে। তবে এবারের ডাকসুই তাদের শেষ গন্তব্য নয়। আদর্শিক ও সাংগঠনিক ভিত মজবুত হলে ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে। ডাকসু নির্বাচনের এই ফলাফলের কারণে এনসিপির রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন না তিনি।
ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিশাল জয়ের বিষয়ে এনসিপির এই নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘প্রথাগত ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে এসে লিবারেল ধারায় মধ্যমপন্থী জায়গা থেকে প্রচার ও প্যানেল সাজিয়েছিল ছাত্রশিবির। ডানপন্থী বা ধর্মভিত্তিক বক্তব্য না টেনে মধ্যপন্থী জায়গা থেকে তারা প্রচার চালিয়েছে, এ বিষয়টিও তাদের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।’
এনসিপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে কোনো না কোনো ভূমিকা থাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের প্রত্যেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। অনেকে সংগঠনের সিদ্ধান্তও মানতে চান না। এর প্রভাবও ডাকসু নির্বাচনে পড়েছে।
বিভাজন
কেন শিক্ষার্থীরা সাবেক সমন্বয়কদের প্যানেল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ওপর আস্থা রাখলেন না, সেটি বোঝার চেষ্টা করছেন এনসিপির নেতারা। তাঁদের মূল্যায়নে উঠে আসছে, প্যানেল নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের মধ্যে বিভাজন দৃশ্যমান হয়ে পড়েছিল। এটা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেননি। এ ছাড়া অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের (যাঁরা হলে থাকেন না) ভোট টানতে না পারাকেও পরাজয়ের বড় কারণ মনে করছেন তাঁরা।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বিভাজনের বিষয়ে এনসিপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ডাকসুর এজিএস পদেই সংগঠনের পাঁচজন নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্যানেল থেকে প্রার্থী ছিলেন আশরেফা খাতুন। তিনি ভোট পেয়েছেন মাত্র ৯০০। একই পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী ৩ হাজার ৮, হাসিবুল ইসলাম ৫০০, আশিকুর রহমান ৭৯৬ ও সানজানা আফিফা ৩৭৩ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন।
এ ছাড়া সম্পাদকীয় কয়েকটি পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতারা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন। কেউ কেউ নির্বাচনের আগে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে অন্য প্যানেলে ডাকসুতে ও হল সংসদের বিভিন্ন পদে প্রার্থী হন।
প্রত্যেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন
এনসিপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে কোনো না কোনো ভূমিকা থাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের প্রত্যেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। অনেকে সংগঠনের সিদ্ধান্তও মানতে চান না। এর প্রভাবও ডাকসু নির্বাচনে পড়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়া দুজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন অনিয়মে জড়ানোসহ এনসিপির কয়েকজন নেতাকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগ এসেছে, কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ ছাড়া এনসিপি ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কয়েকজন নেতা প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কে জড়িয়েছেন। অনেকের কাছে মনে হয়েছে, কাজের চেয়ে তাঁরা বাগাড়ম্বরে বেশি থাকছেন, কাদা ছোড়াছুড়ির গতানুগতিক রাজনীতিই করছেন।
ডাকসুতে ভরাডুবির কারণ জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘জুলাইয়ের সব অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই পরিচয় লুকিয়ে আমাদের মধ্যে ঢুকেছেন। ফলে আমাদের সংগঠন শক্তিশালী হয়নি। আমাদের ভেতর থেকে অনেকেই বিভাজন তৈরি করেছেন, যা দৃশ্যমানও হয়েছে। সংগঠন শক্তিশালী করতে না পারায় আমাদের বিভাজনগুলো প্রকাশ্য হয়েছে। সংগঠিতভাবে কাজ করতে না পারাও আমাদের বড় ব্যর্থতা।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন