মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে, মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি
প্রতিনিধি মাগুরা
![]() |
জন্মের আগেই গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়া এখন নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। গত ২৪ জুলাই মাগুরা সদরের দোয়ারপাড়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ চলছিল ছাত্রলীগের দুই পক্ষের। এর মধ্য থেকে ছুটে আসা একটি গুলি এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেটে লেগে শিশুর শরীরও এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলে। বোমার বিস্ফোরণে প্রাণ হারান এক বৃদ্ধ। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরার এ ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছিল।
জন্মের আগেই গুলিবিদ্ধ শিশুটি এখন নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। অথচ ঘটনার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যা মামলার বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আট বছর চার মাস আগে অভিযোগ গঠন হলেও এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও।
এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যাওয়া নাজমা বেগম। গত সোমবার তিনি বলেন, ‘যে ঘটনায় আমার মেয়ে চোখ হারিয়েছে, স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে; সে ঘটনা আমি কীভাবে ভুলব? আমি সব সময় এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। কিন্তু এখন এই মামলা বা আমাদের খোঁজ কেউই আর নেয় না।’
মামলার নথি ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই বিকেলে মাগুরা শহরের দোয়ারপাড় এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মোমিন ভুঁইয়া (৬৫) নামের একজন নিহত এবং আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম পেটে গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতেই মাগুরা সদর হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাতৃগর্ভ থেকে গুলিবিদ্ধ কন্যাসন্তানের (সুরাইয়া) জন্ম হয়। এ ঘটনায় গুলি ও বোমায় নিহত মোমিন ভুঁইয়ার ছেলে রুবেল ভুঁইয়া ২৬ জুলাই মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন।
প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হচ্ছে সুরাইয়া
ওই ঘটনার পর মাগুরা সদর হাসপাতালে নাজমা বেগমের অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক শফিউর রহমান বলেছিলেন, গৃহবধূর তলপেট বিদ্ধ করে বুলেটটি গর্ভে থাকা শিশুটিকে ভেদ করে পেটের মাংসপেশির ভেতর আটকে ছিল। গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশু গোল হয়ে পেঁচিয়ে থাকে। ফলে নবজাতকের হাত, গলা ও চোখে বুলেটের আঘাত লেগেছে। চোখের ভেতর ঢুকে বুলেটটি বের হয়ে যাওয়ায় চোখটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
মায়ের পেটে থাকতে গুলিবিদ্ধ হওয়া সুরাইয়ার গত ২৩ জুলাই ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে এখন স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে জন্মের পর কিছু স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে সুরাইয়ার। চিকিৎসার মাধ্যমে এরই মধ্যে কিছু সমস্যার উন্নতি হচ্ছে। তাঁরা জানান, সুরাইয়া ডান চোখে একেবারেই দেখতে পারে না। আট বছর বয়সে এসে সে হাঁটা শিখেছে। এখনো ডান পা, ডান হাত ও মাজায় ভারসাম্য পুরোপুরি আসেনি। এ কারণে এখন হাঁটতে পারলেও কিছুদূর গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
চা-বিক্রেতা বাবাকে সুরাইয়ার চিকিৎসা ব্যয়ের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়। মা নাজমা বেগম বলেন, ‘আট বছর পর্যন্ত মেয়েকে কোলেপিঠে করেই চলতে হয়েছে। এখনো নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দিতে হয়। অনেক সময় নিজেই ফিজিওথেরাপি দিই। বারবার মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতে ভালো লাগে না। যদি সরকারি–বেসরকারি কোনো সংস্থার মাধ্যমে সুরাইয়ার চিকিৎসা হতো, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।’
সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি
ঘটনার পাঁচ মাসের মধ্যে তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সেখ সুমনসহ ১৮ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশ পরিদর্শক মো. ইমাউল হক। আলোচিত এ মামলায় জঠরে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়ার মা নাজমা বেগম, বাবা বাচ্চু ভূঁইয়াসহ মোট ৫০ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ ১৭ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর গত আট বছর চার মাসে এ মামলায় ৩১টি শুনানি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। সর্বশেষ এ মামলার শুনানি ছিল গত মে মাসের ২৬ তারিখ। পরবর্তী শুনানি রয়েছে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখে।
বর্তমানে মামলাটি মাগুরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (প্রথম) আদালতে বিচারাধীন। জানতে চাইলে এ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ গত রোববার বলেন, ‘আমাদের নতুন নিয়োগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলাটি আমার কাছে আসেনি। এ কারণে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’ গত আগস্টে সরকার পতনের আগে এই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দায়িত্বে ছিলেন মসিউর রহমান। তিনি সোমবার বলেন, ‘এখন তো আমি দায়িত্বে নেই। এ কারণে নথি না পড়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিটি শুনানির আগে আদালতের পক্ষ থেকে পুলিশের মাধ্যমে সাক্ষীদের কাছে সমন পাঠানো হয়। কখনো কখনো সাক্ষীদের মুঠোফোনেও জানানো হয়। আদালত সূত্র বলছে, মামলার বাদীও সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী রুবেল ভুঁইয়া সোমবার বলেন, ‘আমি সর্বশেষ দুটো তারিখে ছাড়া প্রতিটি শুনানির দিন আদালতে গিয়েছি। গিয়ে পিপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করি, তিনি কিছু বলেন না। আসামিরা আদালতে হাজির হয়, আদালত আবার কয় মাস পর ডেট দেয়। এভাবেই চলছে। গত কয়েক বছরে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।’
দুজন আসামি মারা গেছেন
মামলার নথি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার পর এ পর্যন্ত দুজন আসামি মারা গেছেন। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন মামলার ৩ নম্বর আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আজিবর শেখ (৩৪)। ওই সময় পুলিশ দাবি করে, ১৭ আগস্ট দিবাগত রাতে শহরের দোয়ারপাড়ে আল আমিন এতিমখানা সড়কে কয়েকজন সন্ত্রাসী অবস্থান করছে বলে তারা জানতে পারে। রাতে পুলিশ সেখানে গেলে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। একপর্যায়ে আজিবর গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। যদিও অভিযোগ আছে, ১৭ আগস্ট বিকেলে মাগুরার শালিখা উপজেলার সীমাখালী বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে আজিবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০২২ সালের ২ অক্টোবর জামিনে থাকা অবস্থায় মারা যান মামলার ২ নম্বর আসামি আলী আকবর। তাঁদের দুজনের মৃত্যুর পর এ মামলায় ১৬ জন আসামির বিচার চলছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন