নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। ঘোষণাপত্রে স্বীকৃতির বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।

এতে বলা হয়, ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।’

ঘোষণাপত্র পাঠ উপলক্ষে আজ বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিকেল ৫টার দিকে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে আসেন প্রধান উপদেষ্টা। এরপর তিনি দক্ষিণ প্লাজার সিঁড়িতে মঞ্চের সামনে দাঁড়ান এবং ৫টা ২১ মিনিটে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন। ৫টা ৩৪ মিনিটে ঘোষণাপত্র পাঠ শেষ হয়।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার সামনে দর্শকসারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়  | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং  

এ সময় তাঁর বাঁ পাশে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক এবং জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়কারী টিপু বিশ্বাস।

প্রধান উপদেষ্টার ডান পাশে ছিলেন গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ মাহফুজুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সাবন্তী, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, হেফাজতের ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।

এ সময় বৃষ্টির কারণে অনেককে ছাতা হাতে দাঁড়াতে দেখা গেছে। মঞ্চের সামনের সারিতে বসা সরকারের উপদেষ্টাদের মাথায় ছাতা ধরেছেন প্রটোকলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনেকে ছাতা নিয়েই অনুষ্ঠানস্থলে আসেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার সামনে দর্শকসারিতে বিএনপির নেতারা। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং   

জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ’ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন অভ্যুত্থানের শহীদ মাহফুজুর রহমানের বোন সাবরিনা আফরোজ। তিনি বলেন, সামনের পথ নিষ্কণ্টক নয়। নানা বাধাবিপত্তি আসতে পারে। তাই ধর্ম, বর্ণ, দলনির্বিশেষে সবাইকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঐক্য ধরে রাখতে হবে।

এরপর ঘোষণাপত্র পাঠ করতে মঞ্চের সামনে যান প্রধান উপদেষ্টা। শুরুতে তিনি বলেন, ‘আজকে দেশের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে জাতির যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে আমরা এসেছি, আল্লাহ তার জন্য আমাদের জন্য রহমত বর্ষণ করছেন। আল্লাহর রহমত নিয়ে আমি এই ঘোষণাপত্র পাঠ করব।’

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার সামনে দর্শকসারিতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং     

ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সব শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়া হবে। ১১টি পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে।

যুক্তিসংগত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তিসংগত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হচ্ছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার সামনে দর্শকসারিতে তিন বাহিনীর প্রধানেরা। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়  | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং     

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম–খুন–হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের উপযুক্ত বিচার করার কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে। এতে বলা হয়েছে, বিগত ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামকালে এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সব ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধগুলোর দ্রুত উপযুক্ত বিচার করা হবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করা হবে।

ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জাতির সার্বিক মঙ্গল কামনা করে আমি জুলাই ঘোষণাপত্র আপনাদের সবার সামনে উত্থাপন করলাম। আল্লাহ সকলের জন্য মঙ্গল দান করুন। জাতির জন্য মঙ্গল নিয়ে আসুক। সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।’

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করার পর জাতীয় সংসদ ভবনের ভেতরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনে | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং     

এরপর তিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি করেন।

মঞ্চের সামনের সারিতে ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন মুর্শিদ, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, আইনজীবী মানজুর আল মতিন প্রমুখ।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।  

আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমদ; জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আযাদ; এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, খেলাফতে মজলিসের আমির আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদসহ গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা।