ইউপির কার্যক্রম দোকানপাটে সীমিত, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুলিশ ফাঁড়িতে পরিণত
পরিষদের সব কার্যক্রম চলে দোকানপাটে। ইউনিয়নের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ব্যবহার হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে।![]() |
সাগরে বিলীন হচ্ছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের উড়িরচর ইউনিয়ন। সম্প্রতি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কলোনিবাজার এলাকা থেকে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
২২ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নেই। নেই কোনো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবন। পরিষদের সব কার্যক্রম চলে দোকানপাটে। ইউনিয়নের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ব্যবহার হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে। একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিও চলছে মাত্র তিনজন শিক্ষক দিয়ে। এর বাইরে রয়েছে ইউনিয়নের সীমানা জটিলতাও।
এই অবস্থা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচরের। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ইউনিয়নটিতে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ইউপির সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভাঙন, সীমানা জটিলতা, ভোটার তথ্য হালনাগাদ না থাকাসহ নানা সংকটে আর নির্বাচন হয়নি।
সন্দ্বীপ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দ্বীপটির অবস্থান। এর একাংশ আবার নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অধীনে। ধান, সবজি, মাছ চাষ ও পশুপালনে উড়িরচরের মানুষের মূল জীবিকা। উর্বর মাটি আর পশু পালনের উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় সত্তরের দশকেই স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন এই অঞ্চলের মানুষ। তবে ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দ্বীপটির। পরে এই দ্বীপের মানুষ ঘুরে দাঁড়ালেও সরকারি অনেক সেবা থেকে এখনো বঞ্চিত তাঁরা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৫ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পর দ্বীপটি পরিদর্শন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ উড়িরচরে আসেন। দ্বীপটির বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে তিনি এই দ্বীপটিকে ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়ে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। তবে এই আশ্বাসের আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
![]() |
কার্যালয় না থাকায় দোকানপাট ও বাড়িঘরেই চলে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। সম্প্রতি সন্দ্বীপের উড়িরচর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তোলা | ছবি: ইউপি সচিবের সৌজন্যে |
নির্বাচন নেই ২২ বছর
২০০৩ সালের ২৫ মার্চ ইউনিয়ন পরিষদের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে চেয়ারম্যান হন মো. খায়রুল আলম। ২০০৭ সালে তিনি খুন হন। এরপর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত সদস্য আবদুর রহিম। অথচ চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা।
উড়িরচর ইউপির জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যালয় নির্মাণ হয়নি। জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ইউপি সচিব, সদস্য, সবাই গ্রামের বিভিন্ন দোকানপাটে বসেই দাপ্তরিক কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ২৫ বছরে সাগরের ভাঙনে বিলীন হয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভূমি। এর বাইরে দ্বীপের উত্তর দিকে তৈরি হয়েছে নতুন চর। এক সমময় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দ্বীপটির মানচিত্র ছিল অনেকটা মৎস্য আকৃতির। তবে ভাঙনের কারণে এটি এখন অনেকটা গোলাকার। দ্বীপের দক্ষিণাংশের কয়েকটি ওয়ার্ডও প্রায় বিলীন হয়েছে। আর ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ অংশ ২০১৮ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নে যুক্ত করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা বলেন, তাঁর উড়িরচর ইউনিয়নের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা নেই। এ বিষয়ে জেনে জানাবেন। পরিষদের কার্যালয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগ চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মো. নোমান হোসেন বলেন, তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছেন। এই ইউনিয়নের বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না।
ইউনিয়নের কার্যক্রম গতিশীল করতে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বাসিন্দারা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ইউনিয়নটির পুনর্গঠন ও ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। এই উদ্যোগ স্থানীয় সরকার বিভাগকেই নিতে হবে। যাতে সামনের নির্বাচনে ইউনিয়নটির জনগণ তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পায়।’
![]() |
উড়িরচর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের এই ভবন এখন পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যালয়ে নেই শিক্ষক
দুই জেলার ভিন্ন দুই ইউনিয়ন মিলে উড়িরচর দ্বীপটিতে বসবাসকারী অন্তত ২৫ হাজার মানুষের জন্য নেই একজন চিকিৎসকও। ইউনিয়নের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিও ব্যবহার হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে। অসুস্থতায় চিকিৎসকের দেখা পেতে জলপথে পাড়ি দিতে হয় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অথবা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। মাফিয়া ময়না নামের স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, চিকিৎসার অভাবে তাঁর এক ছাত্রীর প্রসূতি মায়ের গত বছর ট্রলারেই মৃত্যু হয়েছে। দ্বীপে চিকিৎসক থাকলে এই মৃত্যু এড়ানো যেত।
একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেহাল থাকায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীরা সন্দ্বীপ অথবা অন্য শহরে ঝুঁকছেন। উড়িরচরের বাসিন্দা নূর নবি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তাঁর বাড়ি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। জানতে চাইল তিনি বলেন, পড়াশোনার জন্য তাঁকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পরিবার ছেড়ে দূরে থাকতে হয়েছে। এ বয়সের পরিবার থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। তাই উড়িরচরের শিশুরা উচ্চশিক্ষা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘উড়িরচরে আমরা নিজেরা বাঁচি, নিজেরা মরি। খবর নিবের (নেওয়ার) কেউ নাই। উড়িরচরের চেয়ে ছিটমহলের জীবন ভালো।’
![]() |
পুকুরে গেঁথে দেওয়া কংক্রিটের এই সীমানা পিলারের এক পাশে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, অন্য পাশে সন্দ্বীপ। সম্প্রতি উড়িরচর থেকে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচরে যেতে সন্দ্বীপের ডোমখালী ঘাট থেকে ট্রলার রয়েছে। জোয়ার-ভাটার হিসেব মিলিয়ে একেক দিন একেক সময়ে ছেড়ে যায় এগুলো। যাত্রা শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দ্বীপটিতে যাওয়া যায়। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে উড়িরচর দেখা হয়। দ্বীপের তীর ঘেঁষে চলতে চলতেই চোখে পড়ে এক পুকুরের পাড় ধসে পড়ার দৃশ্য। নৌযান থেকে নেমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ইট বিছানো পথে দিয়ে আগাতে দেখা মেলে সারি সারি কলাগাছ, সবজি বাগান আর পুকুর।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ২৫ বছরে সাগরের ভাঙনে বিলীন হয়েছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভূমি। এর বাইরে দ্বীপের উত্তর দিকে তৈরি হয়েছে নতুন চর। এক সমময় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দ্বীপটির মানচিত্র ছিল অনেকটা মৎস্য আকৃতির। তবে ভাঙনের কারণে এটি এখন অনেকটা গোলাকার। দ্বীপের দক্ষিণাংশের কয়েকটি ওয়ার্ডও প্রায় বিলীন হয়েছে। আর ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেশির ভাগ অংশ ২০১৮ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কার্যত ইউনিয়নের অর্ধেক অংশই এখন অন্য জেলার অধীনে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দুই জেলার মধ্যেবর্তী হওয়ায় নাগরিক সেবায় আরও পিছিয়ে পড়েছে দ্বীপটি।
স্থানীয় বাসিন্দা শেখ ফরিদ বলেন, তিনি সন্দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। পরে জানতে পারেন তাঁরা নোয়াখালীর বাসিন্দা। এলাকার প্রবীণ আবুল কাশেম (৮৪) বলেন, ‘আমরা সন্দ্বীপের মানুষ। এখন কাগজে-কলমে নোয়াখালীর বাসিন্দা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে স্থানীয় লোকজনও বিব্রত।’
উড়িরচর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলেন, তিনি যে ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেই ওয়ার্ডটির অস্তিত্ব নেই। প্রায় পুরোটাই বিলীন হয়ে গেছে। এখন তিনি অন্য আরেকটি ওয়ার্ডে বসবাস করছেন। ভাঙনের এই অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় পুরো উড়িরচর বিলীন হয়ে যেতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন