নওগাঁ পৌরসভায় নতুন করে গৃহকর বাড়ানোর প্রতিবাদে নওগাঁ নাগরিক অধিকার নামের একটি সংগঠন মানববন্ধন করেছে। গতকাল রোববার দুপুরে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকায় পৌর কার্যালয়ের সামনে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

নওগাঁ শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কোমাইগাড়ী এলাকার বাসিন্দা আখতারুন বেগম। তাঁর তিনতলা একটি ভবন রয়েছে। এ ভবনের জন্য গত বছর তিনি ৩৬০ টাকা গৃহকর দিয়েছেন। কিন্তু পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়নের পর তাঁর বার্ষিক গৃহকর ৪২ হাজার ১১০ টাকা নির্ধারণ করেছে পৌরসভা, যা আগের তুলনায় ১১৭ গুণ বেশি।

আখতারুন বেগমের মতোই শহরের প্রায় ৩০ হাজার ভবনমালিকের গৃহকর বেড়েছে। ১ জুলাই থেকে নওগাঁ পৌর কর্তৃপক্ষ নতুন নির্ধারিত গৃহকর অনুযায়ী ভবনমালিকদের গৃহকর পরিশোধের নোটিশ দেওয়া শুরু করে। হঠাৎ সর্বনিম্ন ১০ থেকে ১৫০ গুণ পর্যন্ত গৃহকর বাড়ানোয় বিপাকে পড়েছেন ভবনমালিকেরা। পৌর কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে গৃহকর বৃদ্ধি করেছে অভিযোগ করেছেন তাঁরা। এতে ভবনমালিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে নওগাঁ পৌরসভার প্রশাসক ও নওগাঁ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক টি এম এ মমিন প্রথম আলোকে বলেন, আদর্শ কর তফসিল এবং ২০২৪-২৫ সালে ভবনগুলোর আয়তন ও ধরন অনুযায়ী পঞ্চবার্ষিক কর পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কারও আপত্তি থাকলে তাঁরা ৫০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করতে পারবেন। আবেদন রিভিউ বোর্ডে শুনানির পর যৌক্তিকভাবে নিষ্পত্তি করা হবে। তারপরও কেউ অসন্তোষ্ট হলে পৌর প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে পারবেন। পৌর প্রশাসক হিসেবে যেটুকু আইনি ক্ষমতা আছে, সেটা প্রয়োগ করে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ গৃহকর কমাতে পারবেন তিনি।

যেভাবে নির্ধারণ করা হয় গৃহকর

পৌরসভার রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁ পৌরসভায় বাসাবাড়িতে ভাড়ার আয়ের ওপর ভবনমালিকদের কাছ থেকে কর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে কোনো বাসার ভাড়া মাসিক ১০ হাজার টাকা হলে তার বার্ষিক ভাড়ার আয় হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেখানে বাড়ির মেইনটেন্যান্স বা সংস্কার বাবদ দুই মাসের ভাড়ার আয় ২০ হাজার টাকা বাদ দিয়ে সেখান থেকে ২০ শতাংশ গৃহকর নির্ধারণ করা হয়। এই হিসাবে ওই ভবনমালিককে প্রাথমিকভাবে বার্ষিক ২০ হাজার টাকা গৃহকর দেওয়ার জন্য নোটিশ করা হচ্ছে। তবে ওই ভবনমালিক বাসা ভাড়া না দিয়ে যদি নিজে বসবাস করেন, সে ক্ষেত্রেও তাঁর বার্ষিক ভাড়ার আয় ১ লাখ টাকা ধরে সেখান থেকে ১৫ শতাংশ গৃহকর দেওয়ার জন্য নোটিশ করা হচ্ছে; অর্থাৎ ওই ভবনমালিককে তখন বার্ষিক গৃহকর দিতে হবে ১৫ হাজার টাকা।

পৌরসভার সহকারী কর নির্ধারক জুবায়ের হোসেন জানান, সাধারণত দুই পদ্ধতিতে ভবনমালিকদের কাছ থেকে গৃহকর আদায় করা হয়। একটি হচ্ছে গৃহ নির্মাণ ব্যয় এবং অপরটি হচ্ছে ভাড়ার আয়ের ওপর গৃহকর নির্ধারণ। নওগাঁতে আগে থেকেই ভাড়ার আয়ের ওপর গৃহকর নির্ধারণ করা হচ্ছে। গৃহনির্মাণ ব্যয়ের ওপর গৃহকর নির্ধারণ করা হলে ভবনমালিকদের আরও বেশি গৃহকর দিতে হতো।

ক্ষুব্ধ ভবনমালিকেরা

গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে নওগাঁ পৌরসভা কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের খাস-নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা আখতার হামিদের সঙ্গে। তিনি জানান, একতলা বাসার দুটি ফ্ল্যাটে তিনি ও তাঁর ছোট ভাই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। আগে বছরে এই ভবনের জন্য ৫৪০ টাকা গৃহকর দিতেন। এখন তাঁকে ৩২ হাজার টাকা ভাড়া দিতে বলা হয়েছে। অথচ বাসার ধরন ও আয়তন কোনোটাই বদলাইনি। এত গৃহকর কীভাবে বাড়াল, জানতে পৌরসভার আসার পর এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপত্তি থাকলে ৫০ টাকা খরচ করে আবেদন করতে বলছেন।

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাঙ্গাবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাসার আগে গৃহকর দিতাম ৯০০ টাকা, এখন সেই একই বাসার গৃহকর করা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে এই গৃহকর বাড়ানো হয়েছে। পৌরবাসীকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্যই এভাবে গৃহকর বাড়ানো হয়েছে।’  

উকিলপাড়া স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা অটোরিকশাচালক জিয়ারুল হক বলেন, ‘তিন রুমের আধা পাকা একটা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকি। এই বাসার জন্য আগে ৩৬০ টাকা ট্যাক্স দিতাম। এখন পৌরসভা থেকে নোটিশ দিয়ে বলেছে, এই বাসার জন্য আমাকে নাকি ৩০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হবে। আমি যে আয় করি, সেটা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না, এখন নতুন করে ট্যাক্সের বোঝা কীভাবে সামাল দেব।’

প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত

১ জুলাই থেকে ভবনমালিকদের নোটিশ দেওয়া শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন নতুন গৃহকর বাতিলের দাবিতে আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল রোববার দুপুরে শহরের মুক্তির মোড়ে পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেন নাগরিক অধিকার আন্দোলন নামের একটি সংঠনের প্রতিনিধিরা। সংগঠনের আহ্বায়ক আজাদ হোসেন এতে সভাপতিত্ব করেন।

সভায় বক্তারা বলেন, ১৯৮৯ সালে নওগাঁ পৌরসভা প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হয়। কিন্তু এত দিনেও পৌরসভার বাসিন্দারা ন্যায্য নাগিরক সেবা পাননি। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, ভাঙা রাস্তায় চলাচলে দুর্ভোগ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সমস্যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। ন্যূতম নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। অথচ কয়েক বছর পরপর গৃহকর বাড়িয়ে যাচ্ছে। নতুন করে নির্ধারিত গৃহকর প্রত্যাহার করে আগের নিয়মে কর আদায়ের দাবি জানান তাঁরা। অন্যায় কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা।