জন্মশতবর্ষে সমগীতের আলোচনা: সুলতানের ছবির মানুষেরা যেন কোথাও নেই
এস এম সুলতান যে পেশিবহুল প্রান্তিক শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছিলেন, সেই প্রান্তিক মানুষেরাই এগিয়ে এসেছিলেন জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে। তারপর তাঁরা হারিয়ে গেছেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র বা জুলাই সনদেও তাঁদের উপস্থিতি নেই। তাঁদের কথা নেই। এসব মানুষের প্রাণের নিশ্চয়তাও নেই।
শনিবার সন্ধ্যায় শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনায় প্রধান আলোচক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ নিজার এ মন্তব্য করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন সমগীত পান্থপথের দৃকপাঠ ভবন মিলনায়তনে ‘এস এম সুলতানের চিত্রের মানুষদের জাগরণ ও ক্ষমতায়নের আলাপ’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে।
গত বছরের ১০ আগস্ট ছিল বরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মশতবর্ষ। কিন্তু সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাঁকে নিয়ে কোনো আয়োজন হয়নি। এবার বিভিন্ন সংগঠন নানাবিধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই প্রখ্যাত শিল্পীর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সমগীত এই আলোচনা সভা করল বলে সভার সূচনায় জানিয়ে দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন।
প্রধান আলোচক সৈয়দ নিজার বলেন, ‘আমাদের সাধারণ মানুষ হাজার বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়নের ভেতর দিয়ে সংগ্রাম করে টিকে আছে। এই মানুষকে তুলে ধরার জন্যই সুলতান প্রথাগত রীতি ভেঙে ছবি এঁকেছেন। তিনি এই মানুষের শক্তি ও লড়াই করে টিকে থাকার বিষয়টি দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই বলবান মানুষের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ দেখা যায় না। রাজনৈতিক পরিচয়ের তেমন কোনো প্রতীক, চিহ্ন বা ইঙ্গিত তাঁর ছবিতে নেই। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। সুলতান দেখিয়েছেন এই মানুষ সংগ্রাম করে, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিণতি নেই। এবার চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও একই ঘটনা দেখা গেছে।’
আলোচক বলেন, ‘অসংখ্য মানুষ সারা দেশ থেকে, গ্রামগঞ্জ থেকে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন। তারপর সেই মানুষগুলো দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছেন। যে মানুষেরা তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য, গুম, খুন বন্ধের জন্য জীবন দিয়েছেন, হাজার হাজার আহত হয়েছেন, তাঁদের সেই আত্মদানের কথা কেন অভ্যুত্থানের ঘোষণায় থাকল না? কেন এই সাধারণ মানুষগুলো সফল অভ্যুত্থানের পর, সংগ্রামের পর দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যান, সেই অনুসন্ধান আমাদের করতে হবে। সুলতান তাঁর ছবিতে মানুষের সংগ্রাম দেখিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁদের হারিয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানেরও ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এই অনুসন্ধান আমাদের নাগরিক দায়িত্ব।’
অনুষ্ঠানে সমগীতের সংগঠক ও শিল্পী অমল আকাশ বলেন, ‘এস এম সুলতান প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রমী শিল্পী। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ তাঁর দর্শন বা শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি। সুলতান মানুষের শক্তি ও সংগ্রামের পাশাপাশি প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতাকেও তাঁর শিল্পকর্ম ও বিভিন্ন আলাপচারিতায় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার কথা তখন আমরা সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করতে পারিনি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সুলতানকে ভালোভাবে বুঝতেই পারা যায়নি। এখনো আমাদের চিত্রকলা ঔপনিবেশিক রীতিরই অনুসরণ করে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে সরে আসার জন্য সুলতানকে বুঝে নেওয়া এখন সময়ের দাবি।’
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সাগর। তিনি বলেন, ‘সুলতানের মানুষ কেবল গ্রামবাংলার শ্রমজীবী মানুষ নন, তাঁরা সারা বিশ্বেরই মেহনতি মানুষের প্রতীক। সুলতানের ছবি কেবল ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ নয়; তাঁর শিল্পকলা সমাজ ও সময়কে আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন