সাড়ে ১১ বছরেও বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি, বেড়েছে কোন্দল
প্রতিনিধি চট্টগ্রাম
![]() |
| বিএনপির পতাকা |
সাড়ে ১১ বছরেও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যায়নি। কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চলেছে ঢিমেতালে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে চট্টগ্রাম উত্তরের সাতটি আসনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিরোধ আরও চাঙা হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।
সর্বশেষ গোলাম আকবর খন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের মধ্যে গত মঙ্গলবার বিকেলে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির পর রাতে উত্তর জেলা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের প্রত্যাশা, সংঘাত থামিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা নেতৃত্বকে দায়িত্ব দেবে দল; যাতে উত্তরের সাতটি সংসদীয় আসন বিএনপির থাকে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর গোলাম আকবর খন্দকারকে আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির ৪৪ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এই কমিটিতে সদস্যসচিব ও যুগ্ম আহ্বায়ক রাখা হয়নি। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকা ৯ জনকে পরে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এই কমিটি কোন্দল থামাতে পারেনি, উল্টো বেড়ে যায়। সর্বশেষ কোন্দল নিরসনে নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমানের সঙ্গে পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
রাউজানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁরাই বিএনপির অনেক সভা–সমাবেশে হামলা করেছেন। আমি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দিইনি।
গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপিএর আগে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত উত্তর জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল। ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আসলাম চৌধুরী। এরপর আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি। শুধু চলতি বছরের শুরুতে রাউজানে সভাপতি–সম্পাদক দুজনের কমিটি হয়। তবে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা এটির বিরোধিতা করেন। গোলাম আকবরের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠে।
আওয়ামী লীগের সময়ে গত ১৬ বছর রাউজানে বিএনপি মিছিল–সমাবেশ করতে পারেনি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর সেখানে মিছিল করে বিএনপি। এরপর গিয়াস ও গোলাম আকবর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। গত ১৯ মার্চ ইফতার মাহফিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম–রাঙামাটি সড়কের রাউজানে সত্তারহাট এলাকায় তাঁদের দুজনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। এতে ছররা গুলিতে আহত হন গোলাম আকবর খন্দকার নিজেও। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর গাড়িবহরে হামলা করা হয়েছে।
রাউজানে গত বছরের ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১০টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয় শতাধিকবার। তিন শতাধিক মানুষ এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন।
জানতে চাইলে পদ স্থগিত হওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘রাউজানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁরাই বিএনপির অনেক সভা–সমাবেশে হামলা করেছেন। আমি কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দিইনি।’
সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি। শুধু চলতি বছরের শুরুতে রাউজানে সভাপতি–সম্পাদক দুজনের কমিটি হয়। তবে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা এটির বিরোধিতা করেন। গোলাম আকবরের অনুসারীদের দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ ওঠে।
একই অবস্থা মিরসরাই উপজেলায়। ২৪ মার্চ মিরসরাই উপজেলা, বারইয়ারহাট ও মিরসরাই পৌরসভা বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। উপজেলা বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় আবদুল আওয়াল চৌধুরীকে। সদস্যসচিব হন আজিজুর রহমান চৌধুরী। ৮৩ সদস্যের নতুন কমিটির নেতৃত্বে থাকা এই দুজনই উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুল আমিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কমিটিতে নিজেদের পক্ষের প্রতিনিধিত্ব কম থাকায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কমিটি গঠনের প্রতিবাদে ২৫ মার্চ দলের এই অংশের নেতা–কর্মীরা মিরসরাইয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করে ঝাড়ুমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ২৬ মার্চ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যান সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের অনুসারীরা। উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার জামালপুর এলাকায় দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মোহাম্মদ জাবেদ নামের এক যুবক নিহত হন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন বিএনপির অন্তত ১৩ নেতা–কর্মী। পরে কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করেন নেতারা।
![]() |
| চট্টগ্রামের রাউজানে গত মঙ্গলবার বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় ভাঙচুর করা গাড়ি | ছবি: বিএনপির এক পক্ষের পাঠানো |
মঙ্গলবার রাতে রুহুল কবির রিজভীর সই করা চিঠিতে বলা হয়, দলের ভেতর সংঘাত ও হানাহানি সৃষ্টি করে দলীয় শৃঙ্খলা চরমভাবে লঙ্ঘন করায় বিলুপ্ত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিন, মিরসরাই উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব গাজী নিজাম উদ্দিন, বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক দিদারুল ইসলাম মিয়াজী, যুবদল নেতা সিরাজুল ইসলাম ও কামাল উদ্দিনকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
প্রকাশ্যে হানাহানি না থাকলেও হাটহাজারী উপজেলায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক ও প্রয়াত সংসদ সদস্য সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম চৌধুরীর মেয়ে শাকিলা ফারজানার আলাদা আলাদা পক্ষ রয়েছে। এখানেও কোন্দলের কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না।
সাড়ে ১১ বছরেও কেন উত্তর জেলা ও উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা যায়নি, জানতে চাইলে উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কমিটি করা যায়নি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর নির্বাচন সামনে রেখে কৌশলগত কারণে কমিটি হচ্ছে না। নিজের ব্যর্থতা ও কোন্দলের বিষয়টি মানতে নারাজ তিনি।
তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘উপজেলায় সম্মেলনের প্রস্তুতি শেষের দিকে। এরপর উত্তর জেলায় হবে। এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা ও দলকে গুছিয়ে নিতে পারেন, এমন ইমেজসম্পন্ন নেতাদের দল শিগগিরই দায়িত্ব দেবে আশা করি। নেতারা গায়ের জোরে নয়, ত্যাগী ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, এমন লোকজনকে দলে প্রাধান্য দেবেন; যাতে আগামী নির্বাচনে বিএনপি চট্টগ্রাম উত্তরে নিজেদের দুর্গ ধরে রাখতে পারে।’


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন