নজরুল ইসলাম ঢাকা
![]() |
কারাগার | প্রতীকী ছবি |
দেশের কারাগারগুলোতে এখন ধারণক্ষমতার চেয়ে দেড় গুণের বেশি বন্দী আছে। ঢাকাসহ সারা দেশের ৭০টি কারাগারে থাকার ব্যবস্থা আছে ৪২ হাজার ৮৮৭ জন বন্দীর; এখন আছে ৭৭ হাজার ২৯১ জন। অর্থাৎ কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার জন বেশি বন্দী রয়েছে।
কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলাসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় কারাগারে বন্দীর সংখ্যা বেড়েছে।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন পর্যন্ত (গত বছরের ৪ আগস্ট) সারা দেশে কারাগারগুলোতে বন্দী ছিল ৮৮ হাজার। সরকার পতনের পর ১২ আগস্ট বন্দীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৯ হাজারে। এরপর ২১ অক্টোবর সারা দেশের কারাগারগুলোতে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে হয় ৫৫ হাজার ৮২৬। সর্বশেষ ২৮ জুলাই বন্দীর সংখ্যা আরও বেড়ে ৭৭ হাজার ২৯১ জনে দাঁড়িয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার অন্তত ৩৫০ জন বন্দীর বয়স ৭০ বছরের বেশি। বিভিন্ন কারাগারে আছেন তাঁরা। এ ছাড়া একই সময় বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই হাজার নারী কারাগারে আছেন। বিভিন্ন কারাগারে মায়েদের সঙ্গে দুই শর বেশি শিশু রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে সময় ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। এতে কারাগারগুলোতে বন্দী বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তখন আদালতে আইনজীবীও ছিল খুবই কম। বন্দীদের পক্ষ থেকে আবেদন করলেই তাঁরা জামিন পেয়ে যান। এতে বন্দী কমে যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি পুলিশও অভিযানে নামে। গণ–অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলায় আসামি গ্রেপ্তার হতে থাকে। অন্যান্য ফৌজদারি মামলার আসামিও গ্রেপ্তার করা হয়। এতে বন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কারা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিল ৮ হাজার ৫৩৬ জন, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার–১–এ ছিল ১ হাজার ৪৫৭, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার–২–এ ছিল ৩ হাজার ৬৪২ জন, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ হাজার ৪৪০, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ হাজার ৪০৪ জন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ হাজার ৬৮৬, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ হাজার ২৪৯ এবং খুলনা জেলা কারাগারে ১ হাজার ৪১০ জন বন্দী ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দবিরুল ইসলামের মতো অনেক অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তি বিভিন্ন কারাগারে আছেন।
সাবেক মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ সদস্যসহ আটক ২১৪
পুলিশ সদর দপ্তর ও কারা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গণ–অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলায় সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ৩২ জন, সংসদ সদস্য ৪৭ জনসহ মোট ১১৪ জন রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৬২ জন পুলিশ সদস্য, ২৮ জন আমলা, সাতজন সাংবাদিক ও তিনজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন কারাগারে আটক আছেন। তাঁদের মধ্যে ডিভিশন পেয়েছেন ১৫৩ জন।
এর বাইরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মামলায় সারা দেশে এখন পর্যন্ত কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৫৩১টি মামলা হয়েছে।
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত মহিলা কারাগারটি ‘বিশেষ কারাগার’ হিসেবে চালু করা হয়েছে। গত ২১ জুন ২৭০ বন্দীর ধারণক্ষমতার এ কারাগার চালু হয়। ডিভিশন পেয়েছেন, কিন্তু নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে—এমন ভিআইপি বন্দীদের এখানে রাখা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া হিসাব বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২৮ হাজার ৪০০ জনকে, মে মাসে ৪৫ হাজার ২৭৭ এবং জুনে ৪২ হাজার ৩৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের মামলার পাশাপাশি বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের অভিযানের বাইরে যৌথ বাহিনীর অভিযানেও কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবশ্য গ্রেপ্তার এই ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম ৬ জুলাই বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলাগুলোয় অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গ্রেপ্তার অভিযান চলবে।
কারাগারে সত্তরোর্ধ্ব ৩৫০ জন, আছেন নারী–শিশু
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার অন্তত ৩৫০ জন বন্দীর বয়স ৭০ বছরের বেশি। বিভিন্ন কারাগারে আছেন তাঁরা। এ ছাড়া একই সময় বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই হাজার নারী কারাগারে আছেন। বিভিন্ন কারাগারে মায়েদের সঙ্গে দুই শর বেশি শিশু রয়েছে।
জমি দখল ও চাঁদাবাজির মামলায় ঠাকুরগাঁও-২ আসনের (বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার আংশিক) সাবেক সংসদ সদস্য সত্তরোর্ধ্ব দবিরুল ইসলাম দিনাজপুর জেলা কারাগারে আছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম ১০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি, জমি দখল ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ২ অক্টোবর সাবেক এই সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
দিনাজপুর জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মো. মতিয়ার রহমান ৫ জুলাই বলেন, দবিরুল ইসলাম অসুস্থ। তাঁর বয়স ৮০ বছরের মতো। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। এর আগে তাঁকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছে। কারাগারে আসার আগে তাঁর ডান হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দবিরুল ইসলামের মতো অনেক অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তি বিভিন্ন কারাগারে আছেন।
গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলাগুলোয় অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গ্রেপ্তার অভিযান চলবে।
বিশেষ কারাগার চালু
ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত মহিলা কারাগারটি ‘বিশেষ কারাগার’ হিসেবে চালু করা হয়েছে। গত ২১ জুন ২৭০ বন্দীর ধারণক্ষমতার এ কারাগার চালু হয়। ডিভিশন পেয়েছেন, কিন্তু নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে—এমন ভিআইপি বন্দীদের এখানে রাখা হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার–২ চালু করা হয়েছে। এ দুটি নিয়ে দেশের মোট কারাগার এখন ৭০।
কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন ৫ জুলাই বলেন, বন্দীর চাপ কমাতে সরকার নতুন পাঁচটি কারাগার চালুর নির্দেশ দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি চালু করা হয়েছে।
বাকি তিনটির জন্য পুরোনো ভবন খুঁজে পাওয়া গেলেও লোকবলের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না উল্লেখ করে মোতাহের হোসেন বলেন, নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কারাগার তিনটি চালু হলে বন্দীর চাপ কমে যাবে।