প্রতিনিধি রাউজান

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়েরই শৈশবে প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন তাঁর নিজ গ্রাম হাটহাজারীর শিকারপুর ইউনিয়নের ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’। ৯২ বছরের পুরোনো এই বিদ্যালয়টির এলাকায় পরিচিত ছিল ‘মহাজন ফইরের স্কুল’ নামে। চাটগাঁইয়া ভাষায় ‘ফইর’ মানে পুকুর। স্কুলের প্রবীণ শিক্ষকেরা বলছেন, এলাকার একটি পুকুরের পাশে হওয়ায় লোকমুখে স্কুলটির এমন নামকরণ।

‘মহাজন ফইরের স্কুল’ বা ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়টির জন্য জমি দান করেছিলেন ‘১৯৩৭ সাবান’ কারখানার মালিক নুরালী সওদাগরের ছেলে নেয়ামত আলী। মহাজন পুকুরের পাশে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি ভবন বিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে নাম ছিল ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল’। পরে ১৯৭৯ সালে দুই কিলোমিটার দূরে গ্রামেরই আরেকটি জমিতে স্কুলটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে সারা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয় একসঙ্গে সরকারি হওয়ার সময় ‘আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলও’ সরকারি হয়। এরপর এটির নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।

অধ্যাপক ইউনূসের শৈশবের বিদ্যালয়

বাথুয়া গ্রাম ঘুরে, একাধিক বাড়িতে গিয়েও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো সহপাঠীর সন্ধান মেলেনি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, তাঁর সঙ্গে পড়ালেখা করেছেন যাঁরা, তাঁদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই, নয়তো শয্যাশায়ী।

তবে তাঁর সমবয়সী মুহাম্মদ শফি নামের একজনকে পাওয়া যায়। যিনি অধ্যাপক ইউনূসের দেড় বছরের বয়সে ছোট এবং খেলার সঙ্গী ছিলেন। শফি পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর করেছেন জুয়েলারি দোকান। তাঁরও প্রাথমিক পাঠ আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। ৮৪ বছরের প্রবীণ মুহাম্মদ শফির সঙ্গে তাঁর বাসায় বসে কথা হয়। তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের নানা স্মৃতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৪৫ সালে গ্রামের স্কুলটিতে ভর্তি হন অধ্যাপক ইউনূস। পড়েন তৃতীয় পর্যন্ত। শফি তাঁর এক ক্লাস নিচে পড়তেন। জুনিয়র হলেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল একদম সহপাঠীর মতো। খেলেছেন, মেলায় ঘুরেছেন, নাটকও করেছেন একসঙ্গে।

মুহাম্মদ শফি বলেন, শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলেন ইউনূস। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন। ছাত্রাবস্থায় বয়েজ স্কাউটে যোগ দিয়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এসব দেখে সবারই মনে হতো, ইউনূস একদিন অনেক বড় হবেন।

কিশোর বয়স থেকে অধ্যাপক ইউনূস ভালো ছবি আঁকতেন বলে জানালেন মুহাম্মদ শফি। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল। ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ নামে একটি পত্রিকাও বের করতেন ১৯৬১ সালের দিকে। ছোটবেলায় দুই ঈদে গ্রামে আসতেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা এবং নাটক করতেন। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও আসতেন। বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বেড়াতেন সারা গ্রাম। ছাত্রাবস্থায় একবার বক্তৃতা দিতে উঠে মাইক হাতে নিয়ে তিনি হ্যালো বলেননি। বলেছিলেন, ‘মনোযোগ দিন, মনোযোগ দিন’। তার মানে বাংলাচর্চায় ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল।

আলামিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল যে জায়গায় শুরু হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় বাথুয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রহমত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি কথায় কথায় জানালেন, একই স্কুলে অধ্যাপক ইউনূসের শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা আবুল হোসেন মাস্টার। বাবা তাঁকে বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূসকে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। নোবেল বিজয়ী হয়ে যখন ২০০৭ সালে গ্রামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি আসেন, তখন ওই অনুষ্ঠানে নোবেল বিজয়ী ছাত্রকে দেখতে এসেছিলেন তাঁর বাবা। আবুল হোসেন ২০১৩ সালে মারা যান। রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তাহলে অনেক খুশি হতেন। তাঁর ছাত্র যে আজ দেশের সরকারপ্রধান।’

নেই কোনো স্মৃতি

পূর্ব বাথুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না, তাদের বিদ্যালয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পড়তেন একসময়। পঞ্চম শ্রেণির একাধিক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে তারা অবাক হয়। একাধিক শিক্ষার্থী বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘না, এটা তো জানতাম না।’  তবে তথ্যটি জানার পর তারা সবাই উচ্ছ্বসিত হয়।

বিদ্যালয়ে নেই কৃতী শিক্ষার্থীদের কোনো তালিকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিজ কার্যালয়ে বসে প্রধান শিক্ষক নাসিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে এখানে যে অধ্যাপক ইউনূস পড়তেন, সেটা অনেকেই জানেন না। আমরা শিক্ষকেরাও জানতাম না। কোনো কারণে আগে এই তথ্য প্রচার হয়নি। আগের শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে কোনো কৃতী শিক্ষার্থীর তালিকা রাখেননি। এখন এমন একটি তালিকা করার কথা ভাবছি।’

বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক লাকি পালিত প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই গর্বের বিষয়। একজন নোবেল বিজয়ীর প্রাথমিক পাঠ নেওয়া বিদ্যালয়ে আমি শিক্ষকতা করছি, এটা ভাবতেই ভালো লাগে।’

এখন যেমন বিদ্যালয়টি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ছয়জন শিক্ষক আছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৯ জন। বিদ্যালয়টি আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও সেই চিত্র তেমন একটা বদলায়নি। বিদ্যালয়টির ৪৫ বছর পুরোনো ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। শ্রেণিকক্ষে নেই পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক পাখা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার সরঞ্জাম বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা ব্যবহৃত হয় না। শিক্ষকেরা জানালেন, দরজা জানালা ভাঙা বলে চুরির ভয়ে দামি সরঞ্জাম সরিয়ে রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেল, একসময় প্রথম যেখানে আলামিয়া বিদ্যালয়টি শুরু হয়, সেখানে এখন মাদ্রাসার বহুতল ভবন হয়েছে। তারও আধা কিলোমিটার দূরে বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। ওই বিদ্যালয়ের প্রবেশ করতেই দেখা যায়, পুরোনো দোতলা ভবনের দেয়ালে নতুন করে চুনকাম করা হয়েছে। দরজা–জানালা এখনো পুরোনো এবং জরাজীর্ণ। আরেকটু এগিয়ে বিদ্যালয় মাঠে গেলে দেখা যায়, স্থানে স্থানে তিন থেকে পাঁচ ফুট উঁচু বালুর স্তূপ। ফলে মাঠে শিক্ষার্থীদের খেলার কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ঘুরে দেখা গেল, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা কম। দোতলার ডিজিটাল পাঠদান কক্ষে তালা দেওয়া।

শিক্ষকেরা জানালেন, ডিজিটাল পাঠদান এখন বন্ধ আছে। কারণ, সরঞ্জাম তাঁরা সরকারিভাবে পেলেও এখানে রাতে এখানে চুরির ভয়ে রাখা হয় না। কারণ, আগে অনেকবার বিদ্যালয়ে চুরির ঘটনা ঘটেছে।

বিদ্যালয়ের বাইরে কথা হয় আরিফুর রহমান নামের বাথুয়া গ্রামের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ও পরিবেশ আধুনিকায়ন করা হলে এখানে সবাই শিশুদের ভর্তি করাবে। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হওয়ার অন্যতম কারণ পরিবেশ আর পাঠদানের মান ভালো না হওয়া।

প্রধান শিক্ষক নাসিমা আকতারও বিষয়টি স্বীকার করলেন। তিনি বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে অধিদপ্তরের নজরদারি কম ছিল। নানা সমস্যা–সংকট থাকলেও তেমন একটা গুরুত্ব পেত না। গত মাসে অধ্যাপক ইউনূস গ্রামের বাড়িতে আসার আগে আগে সরকারিভাবে শুধু দেয়ালে চুনকাম করা হয়। আর তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

নাসিমা আকতার বলেন, দরজা–জানালা ঠিক না থাকায় মূল্যবান জিনিসপত্র তিনি কার্যালয়ে রাখেন না। আসার সময় আনেন আবার যাওয়ার সময় নিয়ে যান। এমনকি ওয়াই–ফাই নেটওয়ার্কের রাউটারও তিনি নিয়ে যান চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।

জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রোজিনা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই স্কুল সংস্কার এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা কাজ করছি। শিগগির আপনারা পরিবর্তন দেখবেন।’

রোজিনা রহমান বলেন, আগে নানা চাপের কারণে অধ্যাপক ইউনূসের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য কিছু করার থাকলেও তাঁরা সেটি করতে পারেননি। আগামী এক মাসের মধ্যে ওই স্কুলে সব দিকে পরিবর্তন আনা হবে।