প্রতিনিধি যশোর
![]() |
অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ গেমসে অংশ নিতে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমিতে। গত এপ্রিলে যশোর সদর উপজেলার হামিদপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
চারদিকে সবুজ অরণ্য। কোলাহল নেই, তবে পাখির কিচিরমিচির আছে। এমন ছায়াসুনিবিড় গ্রামীণ জনপদে গড়ে উঠেছে একটি ফুটবল একাডেমি। প্রায় বিনা খরচায় সেখানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে খুদে ফুটবলাররা। স্বপ্ন দেখছে আগামী দিনের ফুটবলের ‘মেসি-নেইমার’ হওয়ার। এরই মধ্যে কেউ কেউ জায়গা করে নিচ্ছে জাতীয় দলে।
এই ফুটবল একাডেমির অবস্থান যশোর সদর উপজেলার হামিদপুর গ্রামে। নাম শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমি। এই একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফুটবল খেলে কৃতিত্ব দেখাচ্ছে অন্তত ২০ জন খেলোয়াড়। মেসি-নেইমার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে একাডেমির এক ঝাঁক খুদে ফুটবলার।
চলতি বছর ভারতে অনুষ্ঠেয় অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ গেমসে অংশ নিতে একাডেমিতে ১৫ দিনের ক্যাম্পে অংশ নেন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা। গত ১৭ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ক্যাম্পে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও ইংল্যান্ডের তিনজন প্রবাসী খেলোয়াড়ও ছিলেন।
নিভৃত গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করতে এসে সব সুযোগ–সুবিধা পেয়ে খুশি অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী (ছোটন)। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে গ্রামে এমন মানসম্মত একাডেমি পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। এখানে গাড়ির শব্দ নেই। মানুষের কোলাহল নেই। মাঠের সঙ্গে আবাসিক ভবন। প্রশিক্ষণে শতভাগ ফোকাস করা যাচ্ছে। এবারের ক্যাম্পটি ঢাকার চেয়ে ভালো হচ্ছে। কারণ, ঢাকায় একদিকে আবাসন, অন্যদিকে অনুশীলনের মাঠ। যানজটে রাস্তায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। এখানে ভালো মানের দুটি মাঠ, আবাসনের ব্যবস্থা, খেলোয়াড়দের অভ্যন্তরীণ ব্যায়ামাগারসহ জাতীয় মানের সব সুযোগ-সুবিধা আছে।
২২ একরের সাজানো একাডেমি
হামিদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে ২০১১ সালে শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমির যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে বিদ্যালয়ের মাঠ ভাড়া নিয়ে বছর তিনেক প্রশিক্ষণ চলে। এরপর পাশে জমি কিনে নিজস্ব অবকাঠামোয় ২২ একর ভূখণ্ডে একাডেমির কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে একাডেমিতে ৬০ জন আবাসিক ও ৯০ জন অনাবাসিক প্রশিক্ষণার্থী ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসিকে রেখে প্রশিক্ষণ ও লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের অনাবাসিকে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়।
গত ২৪ এপ্রিল হামিদপুর গ্রামে একাডেমিতে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের মধ্যে বিশাল এলাকাজুড়ে একাডেমি। পাশাপাশি দুটি সবুজ মাঠ। একটি মাঠে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়েরা ও অন্য মাঠে একাডেমির প্রশিক্ষণার্থীরা অনুশীলন করছে। মাঠের এক প্রান্তে একাডেমির পুরোনো ভবন। অন্য প্রান্তে ছয়তলার ভাষাসৈনিক মুসা মিয়া ভবন নামের নতুন আবাসিক ভবন করা হয়েছে। ভবনে স্থাপন করা হয়েছে ব্যায়ামাগার। অনুশীলনের সময় আশপাশের মানুষ মাঠের চারপাশে ভিড় করেন।
![]() |
অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ গেমসে অংশ নিতে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমিতে। গত এপ্রিলে যশোর সদর উপজেলার হামিদপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে চারজন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। অপর ১৬ জন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক যুব জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। এর মধ্যে জাতীয় ফুটবল দলে বর্তমানে খেলছেন মো. আলামিন। ২০২১ সালে রিমন হোসেন ও মো. রয়েল এবং ২০১৯ সালে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান স্বাধীন।
মিফতাউর করিম (সাফিন) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ি যশোর শহরের পালবাড়ি এলাকায়। প্রতিদিন বিকেলে ইজিবাইকে করে সে একাডেমির মাঠে আসে। তার ভাই স্বাধীন একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৯ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পান। বড় ভাই স্বাধীনই তার ফুটবল খেলা শেখার অনুপ্রেরণা। আর্জেন্টিনার মেসির মতো খেলার স্বপ্ন দেখে সে।
প্রশিক্ষণ নিতে টাকা দিতে হয় না
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সানজিদ হাসান চার বছর একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে চলতি বছর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন লিগে (বিসিএল) ঢাকার এলিট একাডেমির হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছে। সে এবার হামিদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সানজিদ বলে, ‘এই একাডেমির কারণে আমি জাতীয় ফুটবল দলে খেলার স্বপ্ন দেখছি। আবাসিকে থাকা-খাওয়াসহ প্রশিক্ষণ নিতে কোনো টাকা দিতে হয় না। বাইরের স্কুলে লেখাপড়ার জন্য মাসে এক হাজার টাকা দিতে হয়। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সুযোগ।’
![]() |
আবাসিক ও অনাবাসিক দুই ধরনের প্রশিক্ষণার্থীদের একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যশোর সদর উপজেলার শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমিতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দুজন পরিচালক, চারজন কোচসহ ১৫ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীর মাধ্যমে একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। একাডেমিটি ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে উল্লেখ করে একাডেমির প্রধান কোচ কাজী মারুফ হোসেন বলেন, আবাসিক ও অনাবাসিক দুই ধরনের প্রশিক্ষণার্থীদের একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আবাসিকে থাকা-খাওয়া ও প্রশিক্ষণ বাবদ প্রতি প্রশিক্ষণার্থীর পেছনে মাসে প্রায় ১৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এসব টাকা একাডেমি বহন করে। শুধু বাইরের বিদ্যালয়ে পড়তে মাসে এক হাজার টাকা নেওয়া হয়। অনাবাসিকে বি ও সি দুটি গ্রুপ আছে। এর মধ্যে সি গ্রুপে বিনা মূল্যে ও বি গ্রুপের প্রত্যেকের কাছ থেকে মাসে ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়।
অনাবাসিক হিসেবে এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে শেখ মাহিন ফয়সাল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ফয়সালের এখনো আবাসিকে থাকার বয়স হয়নি। বাড়ি যশোর সদর উপজেলার সিরাজসিংহী গ্রামে। শুধু প্রশিক্ষণের জন্য তার মা তাকে নিয়ে একাডেমির পাশে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। ফয়সাল ব্রাজিলের নেইমারের মতো ফুটবলার হতে চায়।
পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি
ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিবছরের ১৯ ডিসেম্বর একাডেমির ট্রায়াল (পরীক্ষা) হয়। সেখানে ভর্তি–ইচ্ছুক খুদে ফুটবলারদের প্র্যাকটিক্যাল ও টেকনিক্যাল বিষয়ের পাশাপাশি লেখাপড়া ও শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করা হয়। সেখান থেকে প্রতিবছর আবাসিকের জন্য ১২ থেকে ১৪ ও ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সের দুটি ব্যাচে মোট ৬০ জনকে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া একই প্রক্রিয়ায় অনাবাসিকে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সের ৯০ জনকে ভর্তি করা হয়। সাধারণত অনাবাসিকে যশোর জেলার প্রশিক্ষার্থীরাই থাকে। এ ক্ষেত্রে ফুটবলের দক্ষতা যোগ্যতার বিষয়ে কিছুটা শিথিল করা হয়। কারণ, একটি জেলায় চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্রশিক্ষণার্থী বেশি পাওয়া যায় না।
![]() |
প্রশিক্ষণের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা রয়েছে শামস-উল–হুদা ফুটবল একাডেমিতে। যশোর সদর উপজেলার হামিদপুর গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাহেদী ফাউন্ডেশনের অনুদানে একাডেমির সব খরচ নির্বাহ করা হয়। নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমিরও চেয়ারম্যান তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কর্মকর্তা ও ঝিনাইদহের সাবেক সংসদ সদস্য।
শ্বশুর শামস-উল–হুদার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর নামে একাডেমিটি করা হয় বলে জানিয়েছেন নাসের শাহরিয়ার জাহেদী। তিনি বলেন, শুরুতে যশোরে ফুটবল খেলোয়াড় তৈরির উদ্দেশ্য থাকলেও এখন ব্যাপ্তি জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ১৫ দিনের ক্যাম্প চলছে একাডেমিতে। জুনে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের সাড়ে চার মাসের ক্যাম্প একাডেমিতে করার পরিকল্পনা আছে বাফুফের।
একাডেমির ব্যয় নির্বাহের বিষয়ে নাসের শাহরিয়ার বলেন, জাহেদী ফাউন্ডেশন নামে তাঁদের পারিবারিক একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তাঁর বাবা ভাষাসৈনিক মুসা মিয়া সেটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। পারিবারিক ব্যবসা রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের টাকা ও ছয় ভাইয়ের অনুদান দিয়ে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। একাডেমিও সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।