{getBlock} $results={3} $label={ছবি} $type={headermagazine}

রাজশাহীতে হামলার পর মানুষশূন্য সাঁওতালপাড়া, অভিযোগ বিএনপি কর্মীর বিরুদ্ধে

প্রকাশঃ
অ+ অ-

প্রতিনিধি রাজশাহী

রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা সাঁওতালপাড়ায় হামলার ছয়দিন পরও তছনছ করা বাড়িতে কেউ ফেরেননি। সোমবার সকালে  | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

হামলায় টিনের বেড়া ফুটো হয়ে গেছে। বাইরে থেকেই ঘরের ভেতরে দেখা যাচ্ছে। বিছানায় মশারি টানানোই আছে। মেঝেতে শুয়ে আছে দুটি কুকুর। উঁকি দিতেই ঘেউ ঘেউ করে একটি কুকুর বাড়ির বাইরে এল। গতকাল সোমবার সকালে রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামের সাঁওতালপাড়ায় গিয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়। গত বুধবার দুই দফা হামলার পরে বাসিন্দারা সবকিছু ফেলে পালিয়ে গেছেন। শুধু একটি বাড়িতে একজন বৃদ্ধা যেতে পারেননি বলে থেকে গেছেন।

জেলার পবা উপজেলার ভেতরে দিয়ে বয়ে যাওয়া বারনই নদের তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধের ওপর প্রায় পাঁচ বছর আগে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এই ১২টি পরিবার বাড়ি করে। এর মধ্যে সাতটি পরিবার সাঁওতাল, চারটি ধাঙ্গড় (ওরাঁও) ও একটি রবিদাস সম্প্রদায়ের। বাঁধের ওপরে তাঁদের বাড়ি। তার পরেই রয়েছে মো. বাবলু নামের এক বিএনপি কর্মীর জমি। তাঁর জমির সামনের দিকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো বাড়ি করা নিয়ে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন বাবলু। যদিও জায়গাগুলো পাউবোর। গত বুধবার সকালে এই বাবলুর সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে সাঁওতালপাড়ার বাসিন্দাদের। এর জের ধরে দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুই দফা হামলা হয় এ পাড়ায়। হামলার পরে সবাই বাড়ি ছেড়ে গেছেন।

সোমবার সকালে সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কোনো বাড়িতেই বাসিন্দাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। একটি বাড়িতে একজন বৃদ্ধাকে পাওয়া যায়। তাঁর নাম অমলা দাসী। অমলার কাছ থেকে জানা যায়, তাঁর জামাতার বাড়িতে এসেছিলেন। নিজের বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুরে। অমলা হাঁটতে পারেন না। ১৫ দিন আগে চিকিৎসার জন্য এখানে এসেছিলেন। এই বাড়িতে থেকেই রাজশাহীতে চিকিৎসা করাচ্ছেন। হাঁটতে–চলতে পারেন না বলে এই বাড়িতেই পড়ে আছেন বলে জানান অমলা।

পাশের বাড়িটিতেও কেউ নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাড়ির জিনিসপত্র। ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে বিদ্যুৎ বিলের বেশ কিছু কাগজ। একটি কাগজে দেখা যায়, বাড়িটির মালিক শ্যামল মুর্মু। তিনিই এই সাঁওতালপাড়ার সরদার। শ্যামলের পরের বাড়িটিও একইভাবে তছনছ অবস্থায় দেখা যায়। আরেকটি বাড়ির দেয়ালেও বিদ্যুৎ বিলের কপি পাওয়া গেল। তাতে দেখা গেল বাড়ির মালিকের নাম বেরজন টুডু। বিলের অনুলিপিতে মুঠোফোন নম্বরও আছে। সেই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা সাঁওতালপাড়ায় হামলার ছয় দিন পরও তছনছ করা বাড়িতে কেউ ফেরেননি। সোমবার সকালে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

বেরজন টুডুর পরের বাড়িতেই মশারি টানানো এবং মেঝেতে কুকুর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। বাঁশ দিয়ে তৈরি দুই দরজায় ছোট ছোট দুটি তালা লাগানো দেখা গেল। পরের বাড়িটি মাটির দেয়ালের। সেই দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে জিনিসপত্র। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল হাঁড়িতে ভাত ছিল। এই কয়েক দিনে সে ভাত পচে গেছে। এর পরের বাড়িটিতে কোনো তালা নেই। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বারান্দায় দড়িতে ঝুলছে কাপড়চোপড়। পাড়ার অন্য দুটি বাড়িতেও কেউ নেই।

বাঁধের ওপর একজন ভ্যানচালককে পাওয়া গেল। তিনি যা শুনেছেন তাই বললেন, প্রথমে বাবলুর সঙ্গে সাঁওতালদের হাতাহাতি হয়। পরে দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুই দফা হামলা হয়েছে। বিকেলের হামলায় দলের লোকজন ছিল। দলের পরিচয় জানতে চাইলে আর কথা বলেননি ভ্যানচালক।

নাম প্রকাশ না করে আরেকজন বললেন, ঘটনার দিন সকালে পাড়ার কয়েকজন বাড়ির সামনে বসে দেশি মদ পান করছিলেন। পাশের জমির মালিক বাবলু সেদিক দিয়ে যাওয়ার পথে তাঁদেরকে (সাঁওতাল জনগোষ্ঠী) এভাবে প্রকাশ্যে মদ না খাওয়ার জন্য বলেন। তখন কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে পাড়ার এক নারী বাবলুর শার্টের কলার ধরেন। এরপর পুরুষেরা তাঁকে মারধর করেন। পরে বাবলু আবার তাঁর লোকজন নিয়ে এসে দুই দফা এই পাড়ায় হামলা চালান।

ঘটনাচক্রে বাঁধেই পাওয়া গেল বাবলুর স্ত্রী ডলি বেগমকে। তিনি তাঁদের শ্রমিকদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন। সব কথা খোলাখুলিই বললেন ডলি বেগম। তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের জমির সামনে বাড়ি করেছে। খুব অত্যাচার করে। জমির ফসল হতে দেয় না। কিছু বলাও যায় না। মদ খেতে নিষেধ করায় তারা আমার স্বামীকে মেরেছে। তখন আমার স্বামীও লোকজন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু কাউকে মারেনি। তারা ভয়ে পালিয়ে গেছে।’ বাড়িঘর ভাঙল কে, জানতে চাইলে ডলি বলেন, ওরাই নিজেরা নিজেরাই বাড়িঘর ভেঙে গেছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা সাঁওতালপাড়ায় দুই দফা হামলার পর ভীত-সন্ত্রস্ত বাসিন্দারা ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র সবকিছু ফেলে পালিয়ে গেছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

পুলিশ এসেছিল কী বলে গেছে, জানতে চাইলে ডলি বেগম এবার ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘ঘটনার পর পুলিশ এসেছিল। বলে গেছে যে সাঁওতালরা তাঁদের বাড়িতে থাকবে। কেউ যেন কিছু না বলে। এতই যখন দরদ তাহলে এদের নিয়ে গিয়ে জমি কিনে বাড়ি করে দিক। আপনি এসেছেন, আপনিও নিয়ে যান। নিয়ে গিয়ে এদের বাড়ি করে দেন। এখানে কেন থাকতে হবে।’ এই জায়গা তো পাউবোর, এ কথা বললে ডলি বলেন, ‘সরকারি হলেও তো আমাদের জমির সামনে। আমরা তো খুব অত্যাচারের মধ্যে আছি।’

বিদ্যুৎ বিলের অনুলিপিতে পাওয়া মুঠোফোন নম্বরে ফোন করে পাওয়া যায় এই সাঁওতালপাড়ার সরদার শ্যামল মুর্মুকে। তাঁর কথা থেকে পুরো কাহিনি জানা গেল। তিনি জানান, আগে তাঁদের বাড়ি ছিল গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি এলাকায়। সেই এলাকা থেকে তাঁরা এদিকে কৃষিকাজে আসতেন। দূর থেকে আসতেন বলে এলাকার তিনজন কাউন্সিলর পাঁচ বছর আগে তাঁদেরকে এই পুলের ওপর বাড়ি করতে দিয়েছিলেন। সেই বাড়ি ছেড়ে তাঁরা যে যেদিকে পেরেছেন চলে গেছেন। এখনো ভয়ের মধ্যে আছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শ্যামল মুর্মু বলেন, ‘সেদিন ময়লা ফেলাকে কেন্দ্র করে বাবলু পাড়ার এক মহিলাকে খিস্তি করছিলেন। এতে নিষেধ করলে তিনি রেগে যান এবং মালতি মুর্মু নামের এক মহিলাকে মারধর করেন। তখন পাড়ার যুবক ছেলেরাও বাবলুকে একটু মারে। ঘটনার পর মালতিকেও হাসপাতালে ভর্তি করি।’

শ্যামল মুর্মু জানান, এ ঘটনার পর দুপুরে বাবলু কয়েকজনকে নিয়ে এসে হরি, তাঁর স্ত্রী এবং মেয়েকে মারধর করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে বিকেলে পুলিশ আসে। তারা সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশনা দিয়ে যায়। স্থানীয় বিএনপি নেতা মোকছেদ আলীও পুলিশের সঙ্গে এসেছিলেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যার আগে আবার দলবল নিয়ে গিয়ে পাড়ায় হামলা করেন বাবলু। তাঁদের কাছে হাঁসুয়া, বল্লম ও ছোরা ছিল। এ রকম আক্রমণ দেখে সাঁওতালপাড়ার সবাই পালিয়ে যান। শ্যামল অভিযোগ করেন, পালানোর সময় কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারেননি। সব লুটপাট হয়ে গেছে। তাঁর নিজের বাড়িতে ১০ হাজার টাকা ছিল। সেগুলো লুট হয়েছে। ২৫টি কবুতর ছিল। খাঁচাসহ কবুতরগুলোও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।

এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন বলে জানান শ্যামল মুর্মু। এ বিষয়ে গত রোববার পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ সাঁওতালদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানান। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পবা থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে ইউএনও জানিয়েছেন।

পবা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, বাবলু আগেই একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। সাঁওতালদের পক্ষ থেকে শ্যামল, তাঁর স্ত্রী ও ছোটন নামের আরেকজন এসেছিলেন গতকাল রোববার সন্ধ্যায়। তাঁদের মামলা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন তিন দিন সময় চেয়েছেন। এখন তাঁরা মামলা না করলে তো জোর করে কিছু করা যায় না।

একটি মন্তব্য করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন