প্রতিনিধি চট্টগ্রাম
![]() |
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন |
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিয়ম না মেনে উপসহকারী প্রকৌশলী, কর আদায়কারী, সড়ক তদারককারী, অনুমতিপত্র পরিদর্শক, হিসাব সহকারী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ ও পদোন্নতির এই প্রক্রিয়ায় কোনো বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা।
এই অনিয়ম হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দুই বছরে, যখন মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মেয়রের দায়িত্ব নেন এবং গত বছরের ৫ আগস্টে সরকার পতন হলে ১৯ আগস্ট তাঁকে অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সাড়ে তিন বছরে ঠিক কতজন নিয়োগ পেয়েছেন, তার নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে শেষ দুই বছরে নিয়োগ পাওয়া ১৮৮ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে চসিক। সেই তালিকায় দেখা গেছে, শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়েই এক লাফে উচ্চ গ্রেডের পদে পদায়ন করা হয়েছে অন্তত ৬৪ জনকে।
চসিকের জনবলকাঠামো অনুযায়ী, শ্রমিক পদ ২০তম গ্রেডের। কিন্তু সেখান থেকে ১০ম গ্রেডের উপসহকারী প্রকৌশলী, ১৬তম গ্রেডের কর আদায়কারী বা অনুমতিপত্র পরিদর্শক পদে পদায়ন করা হয়েছে। এ ধরনের পদোন্নতিতে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
চসিকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তখনকার মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, কিছু কর্মকর্তা ও শ্রমিকনেতাদের সুপারিশেই এসব নিয়োগ হয়েছিল। ঘনিষ্ঠদের জন্য পরীক্ষা ছাড়াই চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। পরে তাঁদের পদায়ন করা হয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে।
বর্তমান মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। অনেকে চাকরি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থেকেছেন। তবে এখন আমরা নিয়মে ফেরানোর চেষ্টা করছি। অনুমতি ছাড়া টানা সাত কর্মদিবস অনুপস্থিত থাকলে চাকরিচ্যুতি হচ্ছে।’
এটা মারাত্মক অনিয়ম। স্বজনপ্রীতি ও জনগণের অধিকার হরণের একটি উদাহরণ। সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয় জনগণের অর্থে। সেখানে নিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকলে সাধারণ মানুষের চাকরির সুযোগ নষ্ট হয়।
— মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব
চসিক সূত্র জানায়, দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা। কারণ, অন্যান্য পদে অস্থায়ী নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, পরীক্ষা ও বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক। এ জন্য বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে নিজেদের প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়ে পরে উচ্চ পদে পদায়ন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নথিপত্র বলছে, তাদের অনুমোদিত পদসংখ্যা ৪ হাজার ২২৬। সেখানে কর্মরত আছেন ৯ হাজার ২৮৯ জন। অনুমোদনের তুলনায় ৫ হাজার ৬৩ জন বাড়তি লোক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটিতে।
শ্রমিক থেকে ‘প্রকৌশলী’
রশিদ আহমেদ নামের আরেকজন নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। যোগদানের ১৯ দিনের মাথায় তাঁকে বিদ্যুৎ শাখায় উপসহকারী প্রকৌশলী পদে বদলি করা হয়। তিনি ডিপ্লোমা করেছেন।
এইচএসসি পাস করা জাহেদুল আহসান গত বছরের ৩১ জানুয়ারি শ্রমিক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার ১৭ দিন পর ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে উপসহকারী প্রকৌশলী করা হয়। নিয়োগের ১৪ দিনের মাথায় শ্রমিক থেকে উপসহকারী প্রকৌশলী হয়েছেন এস এম রাফিউল হক মনিরীও।
পুরোনো কাগজপত্রের বেশির ভাগই পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো থেকে দেখা গেছে, শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে বিধি ভঙ্গ করে অন্য পদে পদায়ন করা হয়েছে। এসব এখন তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
জানতে চাইলে রশিদ আহমেদ স্বীকার করেন, তিনি কোনো লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন। আর এস এম রাফিউল হক মনিরী বলেন, কর্তৃপক্ষ তাঁকে যেভাবে নিয়োগ দিয়েছেন, সেভাবে চাকরি করছেন। তবে শ্রমিক পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারেননি। আর জাহেদুল আহসান সভায় ব্যস্ত আছেন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্মচারী বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী, উপসহকারী প্রকৌশলী পদে দুভাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। একটি হচ্ছে সরাসরি ও অন্যটি পদোন্নতির মাধ্যমে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ পদ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৮০ শতাংশ পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। পদোন্নতির পেতে প্রার্থীকে সড়ক তদারককারী বা বাতি পর্যবেক্ষক পদে ১২ বছর চাকরি করতে হবে। কিন্তু এই চারজনের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই মানা হয়নি বলে জানান সিটি করপোরেশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এটা মারাত্মক অনিয়ম। স্বজনপ্রীতি ও জনগণের অধিকার হরণের একটি উদাহরণ। সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয় জনগণের অর্থে। সেখানে নিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকলে সাধারণ মানুষের চাকরির সুযোগ নষ্ট হয়।
যেসব পদে আগ্রহ বেশি
এ ছাড়া প্রকৌশল বিভাগের অধীনে সড়ক তদারককারী হয়েছেন ১৫ জন। একজন হয়েছেন সহকারী প্রোগ্রামার, দুজন জন্মনিবন্ধন সহকারী, ১৩ জন অফিস সহকারী বা সহায়ক, একজন স্টোরকিপার, একজন হিসাব সহকারী এবং একজন ওয়ার্ড সচিব।
চসিক সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, ‘পুরোনো কাগজপত্রের বেশির ভাগই পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো থেকে দেখা গেছে, শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে বিধি ভঙ্গ করে অন্য পদে পদায়ন করা হয়েছে। এসব এখন তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, এটা মারাত্মক অনিয়ম। স্বজনপ্রীতি ও জনগণের অধিকার হরণের একটি উদাহরণ। সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয় জনগণের অর্থে। সেখানে নিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকলে সাধারণ মানুষের চাকরির সুযোগ নষ্ট হয়।