নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

‘গণমাধ্যম সংস্কার প্রতিবেদন পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সরকারকে ব্যাখ্যাযোগ্য রাখা গণমাধ্যমের দায়িত্ব উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, মিডিয়ার (গণমাধ্যম) কাজ সরকারের প্রতিটি কাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা।

আজ শনিবার ‘গণমাধ্যম সংস্কার প্রতিবেদন পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন শফিকুল আলম। দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে এই সেমিনারের আয়োজন করে টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি)। সহযোগিতায় ছিল বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন।

সেমিনারে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা কিন্তু কাউকে বলছি না যে সমালোচনা করবেন না। অবশ্যই সমালোচনা করবেন। কোনো সরকার শতভাগ সঠিক নয়। আমরা চাই “প্রো পিপল পলিসি” (জনবান্ধব নীতি) নিতে। অনেকে সমালোচনা করছেন না? আপনারা অনেক মেধাবী মানুষদের এনে আমাদের সমালোচনা করেন না? কিন্তু ওইটা করতে যেয়ে আপনি এমন ভয়েসকে সুযোগ দিচ্ছেন, যার কাজই হলো প্রতিদিন মিথ্যা কথা বলা।’

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব আরও বলেন, যেসব ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য ছড়ান, তাঁদের বক্তব্যে গণমাধ্যম হস্তক্ষেপ করছে না। এমন পরিস্থিতি গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, ‘আপনার বড় মিডিয়াকে ব্যবহার করে তিনি তাঁর কথাকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সুযোগ করে দিচ্ছেন আপনি। এটাই অনাস্থা সৃষ্টি করছে। তখন মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে, এই লোকটাকে কেন সুযোগ দিচ্ছেন।’

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রিত ছিল অভিযোগ করে শফিকুল আলম বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিতের মৌলিক কাজগুলো অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর কোনো প্রকার প্রশাসনিক চাপ, আইনি হেনস্তা কিংবা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দিয়ে চাপ তৈরি করছে না।’

গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতায় ব্যর্থতা ছিল উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, ‘এই সময়ে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন ও অসংখ্য মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছে। বিএনপি বারবার বলছে, তাদের নেতা-কর্মীদের নামে ৬০ লাখ মামলা দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এগুলো নিয়ে আমরা কতটুকু সত্য সাংবাদিকতা করেছি, সেই আলাপ এখন হওয়া উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতা নিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্তের জন্য আমরা চিঠি লিখছি। জাতিসংঘকে আমরা বলছি, আপনারা বাইরের বিশেষজ্ঞ দেন, তারা তদন্ত করুক, এখানে কী ধরনের সাংবাদিকতা হয়েছে।’

সেমিনারে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর বিজেসির পর্যালোচনা তুলে ধরেন মিঠুন আনোয়ার।

সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি সমন্বিত আইনের প্রস্তাব করেছে বিজেসি। সেমিনারে সম্প্রচার সাংবাদিকদের অধিকার, নীতিমালা, আর্থিক সুরক্ষা, মালিকানা কাঠামো ও সাংবাদিকদের পেশাগত মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেন গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবী, নীতিনির্ধারক, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদ ও আইনবিদেরা।

বিজেসির পর্যালোচনায় অভিযোগ করা হয়, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সম্প্রচারমাধ্যমকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশন সাংবাদিকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে, তা অস্পষ্ট। সম্প্রচার সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সাংবাদিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি জানায় বিজেসি।

বিজেসি মনে করে, সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যম দুই ধরনের গণমাধ্যম। কাজেই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য অভিন্ন বেতনকাঠামো সংগতিপূর্ণ নয়। তা ছাড়া ১৯৭৪ সালের আইন শুধুই সংবাদপত্রের জন্য। তাই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে তা সংশোধন করতে হবে। শ্রম আইনেও সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য আলাদা বিধান যুক্ত করতে হবে।

পর্যালোচনায় বিজেসি প্রস্তাব করে, সম্প্রচারমাধ্যমের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আগেই কর্মীদের বেতনকাঠামো, নীতিমালা ও আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়ে অঙ্গীকারনামা জমা দেওয়ার বিধান করতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য একটি ‘কোড অব এথিকস’ প্রণয়নের দাবি জানায় বিজেসি।

সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি সরকারকে বলেছিলাম, যাতে দ্রুত সময়ে কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়। প্রতিবেদন তৈরির কাজের মধ্যে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা হবে কিংবা আলোচনা হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী গণমাধ্যম সংস্কারকাজের অগ্রগতি নেই।’

গণমাধ্যমের কোনো সংস্কার না করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, বর্তমানে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেটা আবার প্রতিষ্ঠা হওয়া জরুরি। ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার বিপরীতে গণমাধ্যমের নিজস্ব জায়গা অর্জন করা উচিত।

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) চেয়ারম্যান রেজাউল হক রাজার সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য দেন বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর আল মামুন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক খায়রুল আনাম, যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ, চ্যানেল ওয়ানের চিফ ইন এডিটর নাজমুল আশরাফ, আর্টিকেল নাইনটিনের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম অফিসার শাহনেওয়াজ পাটোয়ারী, শরিফুল ইসলাম প্রমুখ।

সেমিনার সঞ্চালনা করেন বিজেসির সদস্যসচিব ইলিয়াস হোসেন।