প্রতিনিধি রাজবাড়ী
রাজবাড়ীতে পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন বেড়েছে। ভাঙন বাড়ির কাছে আসায় দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষক কুদ্দুস সরদার। গত সোমবার বিকেলে দেবগ্রাম এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
একসময় প্রায় শত বিঘা জমির মালিক ছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার মুন্সিপাড়ার কাদের কাজী। স্ত্রী খোদেজা বেগমকে নিয়ে গড়া সংসারে ছিল বড় বাড়ি, আর্থিক স্বচ্ছলতা ও গৃহকর্মী। পদ্মা নদীর ছয় দফা ভাঙনের মুখে পড়ে আজ নিঃস্ব তাঁরা। বর্তমানে অন্যের ৬ শতাংশ জমিতে বাৎসরিক তিন হাজার টাকা ইজারায় বসবাস করছেন। সেই টাকা সময়মতো দিতে না পারায় মালিকের কথাও শুনতে হয়। বৃদ্ধ কাদের কাজী এখন আর কাজ করতে পারেন না। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের কেউ অটোরিকশা চালান, কেউবা দিনমজুর।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, পদ্মার ভাঙনের কারণে মুন্সিপাড়ার কৃষকেরা অপরিপক্ব পাট কেটে নিচ্ছেন। শ্রমিক না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েই নামছেন জমিতে। চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। নদী থেকে কয়েক শ গজ দূরেই দেবগ্রাম বেথুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুশাহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুন্সিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক, মুন্সিপাড়া জামে মসজিদ, মুন্সিবাজারসহ পাঁচটি গ্রাম। ফেরিঘাট থেকে রাজবাড়ীর মিজানপুর পর্যন্ত প্রায় ২৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে।
নদীর পাড়ে বসে থাকা খোদেজা বেগম বলেন, ‘দুই দিন ধইরা বেশি ভাঙতাছে। যে ফ্যালি ভাঙতাছে, বাড়িঘর ধর ধর। আমরা কহানে যাব, খাড়ানের জায়গা নাই। আমরা ছয়ডা ভাঙা দিছি। দুই দিন খাওয়া নাওয়া নাই, রাইতে ঘুমও নাই। ছাওলপোল নিইয়া রাইতে শুইয়া থাহি। যদি দাবাইয় নিইয়া যাই তাইলে উপায় কী? আপনাগের পায়ে ধইরা কইতাছি আমাগোর থাহার মতো তোফিক করে দেন।’
খোদেজা বেগম বলেন, ২৫ থেকে ২৬ বছর আগে দৌলতদিয়ার বাঘাবাড়িতে তাঁদের প্রায় ১০০ বিঘা জমি ছিল। পদ্মার ভাঙনে সরে যান দেবগ্রাম বেথুরী, সেখান থেকে ধোপাগাথী। ছয়বার স্থানান্তরের পর এখন মুন্সিপাড়ায় আছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা তালেব সরদার বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে ভাঙনের শিকার হয়ে মুন্সিপাড়া আসছি। তিন দিন ধরে ভাঙন বেড়েছে। তিন বিঘার পাটের জমি ছিল, এক বিঘা নদীতে গেল। লোকজন পাই না, তাই ঘরের বউ লইয়া একাই পাট কাটছি।’
নদীর পাড়ে বসে থাকা কুদ্দুস সরদার বলেন, ‘পাটখেত, ধানখেত সব ভাইঙা যাইতেছে। ১৫ দিন পর পাট কাটা দরকার ছিল। প্রায় পাঁচ বিঘা জমি এই কয়েক দিন ভাইঙা চুরমার কইরা নিছে। এখন দায় ঠেইয়া পাট কাটা লাগতাছে। অহন ভাবতেছি কী করব।’
নদীভাঙন আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব জামাল মুন্সি বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩৫ বিঘা জমি আছে। যেভাবে ভাঙছে, সব চলে যাবে। কয়েক গজ দূরে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাজার যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করেছি। ব্যবস্থা না নিলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করা হবে।’
গোয়ালন্দের ইউএনও মো. নাহিদুর রহমান বলেন, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে বরাট অন্তার মোড় পর্যন্ত ৮ থেকে ৯টি স্থান চিহ্নিত করে রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দুই দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসককেও জানানো হয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় কিছুই করতে পারছেন না।
রাজবাড়ী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল্লাহ আল আমিন বলেন, রাজবাড়ী সদর, পাংশা, কালুখালী ও গোয়ালন্দ উপজেলার প্রায় ৫৭ কিলোমিটার পদ্মার পাড় ডাম্পিংয়ের মধ্যে গোয়ালন্দের সাড়ে ৮ কিলোমিটার ও রাজবাড়ীর ২০ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন আছে। পানি বাড়ার কারণে স্রোতে ভাঙন বেড়েছে। ২ হাজার ২৮৩ মিটার এলাকাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশাসনিক অনুমোদনের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে সদর উপজেলার ১৫৪ মিটার এলাকায় অনুমোদন পাওয়া গেছে।