নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
সুন্দরবনে আপন আস্তানায় বাঘ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনের বরাতে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের একটি বড় অংশের উৎস সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা। পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের তালিকায় রয়েছে বাঘ, কুমির, হরিণ, সাপ, তক্ষক, কচ্ছপ ও হাঙ্গর।
চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা থাকায় সুন্দরবন থেকে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বন্যপ্রাণী পাচার চোরাচালানকারীদের বেশ লক্ষ্য রয়েছে।
সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁতসহ অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সে কারণে চোরাশিকারিরা দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের বাঘ শিকার করছে। বনদস্যুরাও এখন সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীও শিকার করছে। সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রকৃতি বাঘের টিকে থাকার জন্য খুবই কঠিন। নোনা পানি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিয়মিত ঘটনা। আমাদের উচিত, সুন্দরবনে বাঘের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। বাঘের বিচরণক্ষেত্রগুলোতে হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মাঝে-মধ্যে বাঘের খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এ কারণে বাঘ নদী-খাল পেরিয়ে লোকালয়ে চলে আসে। গ্রামবাসী তখন পিটিয়ে বাঘ হত্যা করে।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে বাঘের মোট নয়টি উপপ্রজাতি ছিল। গত শতাব্দীতে তিনটি উপপ্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলোর মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। দুই হাজার ৬০০ বছর ধরে এই বাঘ সুন্দরবনসহ বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় এলাকায় টিকে আছে।
তবে বাংলাদেশের বাঘ সংরক্ষণে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার কারণে বাংলাদেশে বাঘের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুন্দরবন নিজেই এখন হুমকিতে। অবৈধ শিকারের কারণে বাংলাদেশের বাঘ এখনো বড় ধরনের ঝুঁকিতে।
দীর্ঘদিন ধরে চোরাশিকারিরা শিকার করে চামড়া, হাড়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করে আসছে। এখনো পর্যন্ত বাঘ সংরক্ষণের মূল চ্যালেঞ্জই বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার রোধ।
র্যাব, পুলিশ, বনবিভাগ ও বনজীবী সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাঘ হত্যায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়। চোরাশিকারিরা সুন্দরবনে বিভিন্নভাবে বাঘ হত্যা করে। ‘গডফাদার মহাজন’ এর কাছ থেকে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে ছদ্মবেশে বনে ঢোকে একশ্রেণির শিকারী। কখনও গুলি করে, আবার কখনও ফাঁদে আটকে বাঘ শিকার করে তারা।
ছাগল বা হরিণ মেরে সেগুলোর শরীরে বিষ মেখে বাঘের খাবার হিসেবে বনে ফেলে রাখা হয়। বাঘ এসব বিষমাখা মৃতপ্রাণী খেয়ে বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা যায়, আর তা না হলে মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। তখন সহজে হত্যা করা হয়।
মৃত বাঘের শরীর থেকে চোরা শিকারিরা চামড়া, মাংস, চর্বি, মাথার খুলি, দাঁত, পুরুষাঙ্গ, হাড়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে। এরপর আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের কাছে এসব চড়া দামে বিক্রি করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কালোবাজারে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বনসংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানান, 'বন্যপ্রাণী শিকারী ও বনদস্যুদের গ্রেপ্তারে বনবিভাগ, পুলিশ, র্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে। আমাদের লোকবল অপ্রতুল। তারপরও এ অপ্রতুল লোকবল দিয়ে আমরা যতটুকু সম্ভব আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি।'
বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার বন্ধে সুন্দরবনে ঢোকা এবং বের হওয়ার নদী-খালগুলোর মুখে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে সুন্দরবনের বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাঘের বিচরণক্ষেত্র কমেছে। পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি না পাওয়ায় লবণাক্তপানি পান করে বাঘ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বার্ধক্যজনিত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগও কিছু বাঘ মারা যাচ্ছে।'
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা বিভাগীয় বনকর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, 'এখন সুন্দরবনের বাঘের প্রধান হুমকি তিনটি- বাঘ হত্যা, বাঘের শিকার প্রাণী হরিণ হত্যা এবং বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।'।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে বাঘের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আবাসস্থল সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।'
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৩ মার্চ ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ প্রকল্পের দুটি অংশ রয়েছে। যার একটি হলো বাঘ জরিপ ও অন্যটি বাঘ সংরক্ষণ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপংকর বর জানান, '২০২৪ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৯.৬৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের তুলনায় ১৭.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।'
২০০৪ সালে দেশে বাঘের সংখ্যা ছিলে ৪৪০টি। যার মধ্যে ১২১টি পুরুষ, ২৯৮টি স্ত্রী এবং ২১টি বাচ্চা। ২০০৯ সালে ৩০০-৫০০টির বাঘের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলে বলে বন অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেশে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় হয় ২৫০টি।
আর ২০১২ সালে ডব্লিউটিপির জরিপে জানা গেছে, দেশে এক দশকে বাঘের সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানানো হয়। এরপর ২০১৫ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০৬টি।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'গত পাঁচ-সাত বছরে সুন্দরবনের প্রাণীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাঘ যেসব প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে সেগুলোর পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতিক সময়ে সন্দরবন ঘুরতে যাওয়া পর্যটনকরাও বাঘের চলাচল কিংবা নদী পার হওয়ার চিত্র বেশি দেখতে পাচ্ছেন।'