নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা

ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত ১১তম মানবাধিকার সম্মেলনে বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘কোনো দল যখন চিন্তা করে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাব, তখন ভয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ কম করে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কম করে। কোনো দলের ক্ষমতা হারানোর ভয় চলে গেলে তারা দানবে পরিণত হয়। যেটি আমরা বিগত আওয়ামী শাসনামল দেখলে বুঝতে পারি।’

আসিফ নজরুল আরও বলেন, ‘সবার আগে রাষ্ট্রের তিনটা প্রধান অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই তিন বিভাগে সমস্যা রেখে কোনোভাবেই মানবাধিকার ঠিক রাখা যাবে না। আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমরা এই জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি।’

আজ শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত ১১তম মানবাধিকার সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এই সম্মেলনের আয়োজন করে।

সংগঠনটির চেয়ারপারসন শাহজাদা আল আমিনের সভাপতিত্বে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী মো. নুর খান, জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় (ইউএনআরসিও) বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ একরামুল হক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক সাইফুদ্দিন আহমেদ বক্তব্য দেন। এ ছাড়া জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের সদস্যরা, আহত ও গত সরকারের সময় গুমের শিকার ব্যক্তিরা সম্মেলনে বক্তব্য দেন।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘১৯৯১ থেকে ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত দেশে মোটামুটি ভালো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার এসেছিল। যার কারণে আমরা কিছুটা হলেও ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৩ সালের সময়েও অনেকগুলো মেয়র নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত স্বচ্ছতা ছিল।’

অনেকে বলেন নির্বাচন মানেই কি সবকিছু নাকি—এই কথা উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি যাঁরা বলেন, তাঁদের দেখা উচিত বাংলাদেশে সেরা সময় কেটেছে ১৯৯১ থেকে ২০১২-১৩ পর্যন্ত। কারণ, তখন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার হস্তান্তর ছিল। এটি থাকলে জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকে। তখন দেশ ভালোর দিকে এগিয়েছে। আমাদের দলগুলোর প্রত্যেকের তো সমস্যা আছে। কোনো দল যখন চিন্তা করে পাঁচ বছর পর ক্ষমতা হারাব, তখন ভয়ে হলেও তারা খারাপ কাজ কম করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কম করে। কোনো দলের ক্ষমতা হারানোর ভয় চলে গেলে তারা দানবে পরিণত হয়। যেটা আমরা বিগত আওয়ামী শাসনামলে দেখলে বুঝতে পারি। যার কারণে এক হাজারের বেশি ছাত্র–জনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু হয়ে যেতে হয়েছে। কত কঠিন ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে।’

মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘তারপরও আমাদের আশাবাদী থাকতে হবে। তবে আশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকতে হবে। আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। কিন্তু সেটি হঠাৎ করেই হবে না। ক্রমান্বয়ে আমরা ভালোর দিকে এগোব। ভালো মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে যাব। এ জন্য মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি আগামী তিন–চারটা নির্বাচন যদি সঠিকভাবে করতে পারি, আইনগত প্রশাসনিক সংস্কার যদি সঠিকভাবে চলে, সবার মধ্যে মানবাধিকার চর্চার অনুশীলনটা যদি গড়ে ওঠে, তাহলেই আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’

রাষ্ট্রের তিনটা প্রধান অঙ্গে সমস্যা রেখে কোনোভাবেই মানবাধিকার ঠিক রাখা যাবে না উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘মানবাধিকার বাস্তবায়ন খুবই কঠিন কাজ। অনেকে মনে করেন ভালো কিছু আইন করলেই বোধ হয় মানবাধিকার সমস্যার সামাধান হয়ে যাবে। আসলে হবে না। সবার আগে রাষ্ট্রের তিনটা প্রধান অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই তিন বিভাগে সমস্যা রেখে কোনোভাবেই মানবাধিকার ঠিক রাখা যাবে না। আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমরা এই জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছি।’

মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান বলেন, জুলাই ও আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে এক বছর হতে চলেছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আগের ফ্যাসিস্ট যেই কাজগুলো করেছে, সেই কাজগুলো যাতে আমরা না করি। ভেবে দেখেন এক বছর আগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বললে কী পরিণতি হতো। ...স্বৈরাচারের চেয়েও বড় স্বৈরাচারের দিকে যাচ্ছে দেশ। এটি যদি এখনই না থামিয়ে দেওয়া যায়। পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে কিন্তু ধ্বংস করে দেবে। স্বৈরাচার কিন্তু শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে না। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরেও স্বৈরাচার মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় থাকে। সেটিকেও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।’

আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সামনে দুইটা বড় এবং কঠিন দায়িত্ব এই মুহূর্তে। এক হলো জুলাই এবং তার আগে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তার বিচার করতে হবে। এসব পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু ক্ষতিপূরণ দিলে হবে না, তাদের জীবনটা আসলে কীভাবে মেরামত করা সম্ভব, সেটির চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি কেন এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলো? আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা যাদের কাজ, তারা কেন উল্টো দিকে চলে গেল। সেটির কারণও খুঁজে বের করতে হবে।’