মহিউদ্দিন ঢাকা
![]() |
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বিদ্যুৎ উৎপাদন দেরির জন্য সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়াকে দায়ী করে আসছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুরের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নির্মিত সঞ্চালন লাইন ২ জুন চালু করেছে সরকারের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ। সঞ্চালন লাইন চালুর দুই মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। তবে এটি আরও কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূত্র বলছে, সময়মতো উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রূপপুরে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ছয় মাস ধরে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ আসা বন্ধ আছে। কর্মীদের ছাঁটাইসহ বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে হঠাৎ করে অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে খোদ রাশিয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোসাটম।
রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পাবনার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় ঠিকাদার হিসেবে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুরে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ তদারক করতে ও রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি বুঝে নিতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পাঠানো চাহিদার ভিত্তিতে ছয় মাস পরপর দেশটি থেকে বিশেষজ্ঞরা আসেন। গত জুলাইয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা মেয়াদ শেষ করে ডিসেম্বরে চলে গেছেন। এর পর থেকে নতুন করে আর ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চেয়ে চাহিদা পাঠায়নি রূপপুর। এতে কাজে যথাযথ তদারকি হচ্ছে না।
তবে রূপপুর কর্তৃপক্ষ বলছে, চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি ও উৎপাদনের পুরোটা বুঝিয়ে দেবে রাশিয়া। প্রয়োজনীয়তা বুঝে তারা একেক দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনে। বিভিন্ন দেশের লোক কাজ করে রূপপুরে। তাই ভারতীয়দের আনার বিষয়টা রোসাটমের হাতে। এটি বাংলাদেশের বিষয় নয়।
চাকরিতে বৈষম্যের প্রতিবাদে গত আগস্টে বিভিন্ন দাবি জানান রূপপুরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনাও হয় তাঁদের। গত ৬ মে বিভিন্ন দাবি জানিয়ে রূপপুর প্রকল্পের বাইরে ঈশ্বরদী এলাকায় মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে তারা। এরপর রূপপুরের ১৮ জন কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ৯ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে চাকরি নিয়ে ছাঁটাই আতঙ্কে আছেন অন্যরা। চাকরি হারানো কর্মকর্তারা উচ্চ আদালতে রিটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রূপপুর কর্তৃপক্ষ বলছে, যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে মূল বেতন রূপপুরে আড়াই গুণ বেশি। তাঁদের তো অসন্তুষ্টির কোনো যৌক্তিকতা নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনেও আসেনি, অথচ তাঁরা সর্বোচ্চ সুবিধা পাচ্ছেন। আর যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাঁরা দোষী হিসেবে চিহ্নিত। এ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এটি চালানো যেত না।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাকরিচ্যুতরা বলছেন, তাঁরা মেধার ভিত্তিতে বাছাই হয়ে চাকরি পেয়েছেন। এরপর রাশিয়ায় তাঁদের ১৮ জনের প্রশিক্ষণের পেছনেই সরকারের খরচ হয়েছে আনুমানিক ২১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। গত কয়েক বছরে তাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সরকারি বেতন নিয়েছেন। অথচ হঠাৎ করেই কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিকল্প জনবলও তৈরি নেই রূপপুরে। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল কারিগরি কাজটি তদারক করেন চিফ সুপারিনটেনডেন্ট, তাঁকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে মুশফিকা আহমেদকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁর যথাযথ অভিজ্ঞতা নেই।
এটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ২৭ মে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দিয়েছে রোসাটম। এতে বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার আগের এ মুহূর্তে চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত সব কারিগরি ও সাংগঠনিক নানা বিষয়ের দায়িত্ব ওই কর্মকর্তার হাতে। তিনি হবেন উৎপাদন কমিটির প্রধান ব্যক্তি। এমন পদে দায়িত্ব নিতে কিছু প্রশিক্ষণ থাকাটা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে ১ হাজার ৭২ ঘণ্টার তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ ও ৩৪০ ঘণ্টা কাজের প্রশিক্ষণসহ আরও বেশ কিছু দক্ষতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা অর্জনের এক বছর পর তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বলে জানানো হয় চিঠিতে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কোম্পানির চেয়ারম্যান ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, যারা উপদ্রব করেছে, তাদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আরও যদি কেউ উপদ্রব করে, একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছে। এটা তো তৈরি পোশাকের কারখানা নয়, স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান এটি। আর এখানে বাড়তি জনবল প্রশিক্ষণ দেওয়া আছে, কাজে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সময় দফায় দফায় পেছাচ্ছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। এটি পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া হয়। এখন আরও পেছাচ্ছে। আর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি পিছিয়ে ২০২৫ সালে নেওয়া হয়েছিল। তবে এটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে ২০২৭ সালে। জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ছিল প্রকল্পের মেয়াদ। গত বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও খরচ বাড়াতে পারবে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গত সেপ্টেম্বরে চুল্লিপাত্রের ভেতর ‘ডামি’ জ্বালানি প্রবেশ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। সঞ্চালন লাইন তৈরি হয়েছে। এর দুই মাস পর চুল্লিপাত্রে পারমাণবিক জ্বালানি প্রবেশ করানো হবে। জ্বালানি প্রবেশে এক মাস সময় লাগে। এরপর কিছু কিছু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। একই সঙ্গে চলবে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এতে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে রূপপুরের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে আগামী বছর। তবে এটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
মোকাব্বির হোসেন বলেন, ডিসেম্বরে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হতে পারে। তবে এটি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিকঠাক হওয়ার ওপর নির্ভর করে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি প্রবেশের পর অন্তত ছয় মাস ধরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলবে। এ সময় ধাপে ধাপে পরীক্ষা ও আন্তর্জাতিক অনুমতি নিতে হবে। এতে আগামী বছরের আগে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর তেমন সম্ভাবনা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, দুই বছর পেছানোর পরও রূপপুর প্রকল্প কবে নাগাদ চালু হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এটা হতাশার। পারমাণবিক স্থাপনা ব্যবস্থাপনার পরিবেশ এখন রূপপুরে নেই। পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি প্রতিরোধে নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। উৎপাদনের আগে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও প্রস্তুতিতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। বর্তমান সরকার এ প্রকল্পে তেমন অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। অথচ রূপপুরের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এ সংকট বিরাজমান থাকলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাস্তবিক অর্থেই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এতে প্রকল্পের খরচও বাড়তে পারে।